ময়মনসিংহে একাত্তরে আলেম সমাজের অবদান অবিস্মরণীয়

নিউজ ডেস্ক

নতুনের সাথে আমরা

প্রকাশিত : ১১:৩৬ এএম, ৬ ডিসেম্বর ২০২১ সোমবার

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

একাত্তরে হায়েনার থাবায় ক্ষতবিক্ষত ময়মনসিংহে, বিভিন্ন বধ্যভূমিতে গণহত্যার শিকার হাজার হাজার শহীদের রক্তস্রোতে রঞ্জিত হয় ব্রহ্মপুত্র। কিশোরগঞ্জ ছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহ ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর ২৭ মার্চ রাত ১২টা থেকে ১৮ ঘণ্টাব্যাপী রক্তক্ষয়ী প্রতিরোধ যুদ্ধে ময়মনসিংহের ইপিআর (বর্তমান BGB) ক্যাম্পে প্রথমেই শহীদ হন দেলোয়ার, আনোয়ার, আবু তাহেরসহ অন্তত সাতজন বাঙালি।

একাত্তরের মুক্তি-সংগ্রামে আলেম সমাজের অবদান অবিস্মরণীয়। অথচ অজ্ঞতাবশত অনেকে ধর্মপ্রাণ-নিরীহ মানুষকে স্বাধীনতাবিরোধী হিসেবে চিত্রিত করেন, তাদের নাটক-সিনেমার ‘খল চরিত্র’ হিসেবে পোশাকি ব্যবহার দুঃখজনক।

অসংখ্য প্রাণের বিনিময়ে আমাদের পতাকা হয়েছে লাল-সবুজে গাঢ়-রঙিন। খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল. (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীকের প্রাসঙ্গিক বিবরণ চমকে ওঠার মতো :

‘ময়মনসিংহের ভালুকার প্রায় দুই কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে অবস্থিত ০৭ নম্বর মল্লিকবাড়ি ইউনিয়নের রূপী নদীর তীরের ভাণ্ডাব (বয়টাপাড়া) গ্রামের মসজিদের পেশ ইমাম ও স্থানীয় মাদরাসার শিক্ষক ছিলেন ছফির উদ্দিন মুন্সী। তিনি মিষ্টভাষী, নম্র-ভদ্র স্বভাবের সৎ-সাহসী ও সরল প্রকৃতির মানুষ। ১৯৭১ সালের ১৮ জুলাই মঙ্গলবার মুয়াজ্জিন ছুতি মণ্ডলের কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছিল ‘আশহাদু আন লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ...’ ছফির উদ্দিন মুন্সী নিচ্ছিলেন নামাজের প্রস্তুতি। হানাদার বাহিনী আর ওদের উচ্ছিষ্টভোগী চেলা-চামুণ্ডারা ছুতি মণ্ডলকে গুরুতর আহত-অচেতন করলে তার আর ফজরের আজান শেষ করা হলো না। ওরা ইমাম ছফির উদ্দিন মুন্সীর বাড়িতে হামলা চালায়। ওরা একে একে চার সন্তানের জনক ছফির উদ্দিন মুন্সী ও তার স্ত্রী নসিমন্নেসা, ভাই ডাক্তার সামাদ (পাকিস্তান জিন্দাবাদ বলতে অস্বীকৃতি জানান) তাঁর স্ত্রী খাদিজা বেগম ও সামাদের পুত্র আ. করিমকে গুলি করে হত্যা করে। ওরা রক্তাক্ত লাশসহ বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে ঘরের পাঁচটি কোরআন শরিফ ও ধর্মীয় কিতাবাদি জ্বলে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে লাশগুলোও শনাক্ত করা যাচ্ছিল না। তাদের অপরাধ একটাই, ছফির উদ্দিন মুন্সী মুক্তিযোদ্ধাদের সংবাদ সরবরাহসহ সাধ্যমতো সাহায্য করতেন।

আজও কেউ জানল না, কেন মসজিদের নিরিহ ইমাম ও মাদরাসা শিক্ষক ছফির উদ্দিন মুন্সী ও পরিবারের পাঁচজন মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে তাদের লাশগুলো পুড়িয়ে ফেলা হয়েছিল। ভাণ্ডাব মসজিদের পাশেই রয়েছে পাঁচ শহীদের সমাধি। নির্মম এ গণহত্যার সাক্ষী শুধু দেয়ালে খোদাই করা নাম ও পাশে বয়ে চলা রূপী নদী।’

একাত্তরের ১৩ নভেম্বর নির্মমভাবে শহীদ হন ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ভবানীপুর ফাজিল মাদরাসার শিক্ষক ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সহসভাপতি ইসমাইল হোসেন মাস্টার। তাঁর প্রচেষ্টায় ভবানীপুর মাদরাসার আটজন শিক্ষক, ছয়জন ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং মাদরাসাছাত্র আ. বারী, আ. কাদির শহীদ হন।

নন্দিত কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের ‘জোসনা ও জননীর গল্প’ সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের কোনো এক স্কুলের ধর্মীয় শিক্ষক ও মসজিদের ইমাম মওলানা ইরতাজ আলী কাসিমপুরী, যিনি কাহিনি সূত্রে পূর্বাপর আলোচিত। তিনি পাক আর্মির অন্যায় ‘ধর্মান্তর’ প্রক্রিয়ার প্রতিবাদ করে পরাধীন দেশে জুমার নামাজ পড়াতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপনের ফলে নির্মমভাবে শহীদ হন। একজন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ শুনে হুমায়ূন আহমেদ এ তথ্য লাভ করেন।

মহান স্বাধীনতার লড়াকু সৈনিক মওলানা শামসুল হুদা পাঁচবাগী (রহ.) ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন বঞ্চিত মানুষের অভিভাবক ও বিপন্ন মানবতার দিশারি। একাত্তরে মওলানা পাঁচবাগী (রহ.) সরাসরি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে অবস্থান নেন। তাঁর পাকিস্তানবিরোধী ইশতেহার :

‘পাকিস্তান হয় ফাঁকিস্তান, পাকিস্তান হবে  জালেমের স্থান।’

আমাদের আলেম সমাজ স্বাধীনতাসংগ্রামে নিজ যোগ্যতায় নেতৃত্বও দিয়েছিলেন। যাঁদের অন্যতম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাঁর সংগ্রামী জীবনের বিরাট অংশজুড়ে আছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ।