ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৫ ১৪৩০

আমরা সবাই আসলে মাটির সন্তান (And of Clay Are We Created)

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:০৮, ১৯ নভেম্বর ২০২০  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

পটভূমিঃ এটি একটি কল্পকাহিনী। তবে বাস্তব ঘটনার উপরে ভিত্তি করে লেখা। ১৯৮৫ সনে কলম্বিয়াতে একটা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ঘটে। উত্তাপের কারণে এ সময়ে পর্বতের গায়ের বরফের আস্তরণগুলো গলে গেলে কাদামাটির ধ্বসের সৃষ্টি করে। ২৩,০০০ এর অধিক সংখ্যক মানুষ এতে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। মিডিয়ার প্রধান ফোকাসে চলে আসে কাদামাটির ভেতরে আটকে পড়া ১৩ বছরের এক কিশোরী। এই গল্পে মেয়েটির নাম ব্যবহার করা হয়েছে এযুসেনা (Azucena) এবং তার উদ্ধারকারীর নাম রলফ কার্লে (Rolf Carle) হিসেবে।

মেয়েটার মাথা বেরিয়ে ছিলো একটা মাটির গর্তের ভেতর থেকে। তার দুই চোখ প্রসারিত ও  বিস্ফারিত। নিঃশব্দভাবে সে ডাকাডাকি করছিলো। পরিবার সুত্রে তার নাম ছিলো এযুসেনা। অর্থ  লিলি ফুল। সেই বিশাল সমাধিক্ষেত্রের ভেতরে মৃত্যু দূর থেকে শকুনগুলোকে ডেকে আনছিলো এবং ক্রন্দনরত এতিম শিশুদের চিৎকারে সেখানকার বাতাস পূর্ণ হয়ে গিয়েছিলো। একই সময়ে সেই  মেয়ে একরোখাভাবে ট্র্যাজেডির প্রতীক হয়ে জীবনের সাথে ঝুলে ছিলো। টেলিভিশন ক্যামেরা তার বের হয়ে থাকা মাথার অসহ্য দৃশ্যটাকে বার বার এমনভাবে ধারণ করছিলো যে, সেটাকে মনে হচ্ছিলো একটা স্কোয়াশ বল। এমন কেউই ছিলো না যারা তার নাম জানতো না এবং তাকে চিনতে পারেনি। যতবারই আমরা তাকে টেলিভিশনের পর্দায় দেখছিলাম, ততবারই  তার ঠিক পেছনে দেখা যাচ্ছিলো রলফ কার্লেকে। সে সেখানে গিয়েছিলো উদ্ধারের কাজে এবং কখনোই চিন্তা করেনি যে, সেখানে সে খুঁজে পাবে তার অতীতকালের এক টুকরো। যা সে হারিয়েছিলো ৩০ বছর পূর্বে। 
        
মাটির অন্তঃস্থলের কম্পনটা প্রথম অনুভূত হয় তুলার ক্ষেতে। ফেনার ঢেউয়ের মতো এই কম্পন  আবর্তিত হচ্ছিলো। অবশ্য  ভূতাত্ত্বিকরা কয়েক সপ্তাহ পূর্বেই সিসমোগ্রাফ স্থাপন করেছিলো এবং তারা জানতো যে, পর্বত পুনরায় জেগে উঠেছে। তারা এটাও ধারণা দিয়েছিলো যে, অগ্ন্যুৎপাতের  উত্তাপের ফলে আগ্নেয়গিরির ঢালুর বরফগুলো পৃথক হয়ে যেতে পারে। কিন্তু কেউই তাদের সতর্কবার্তা শুনেনি। সবার কাছে এই সতর্কবাণীকে মনে হয়েছিলো ভীতসন্ত্রস্ত একজন বর্ষিয়সী মহিলার মুখের প্রলাপের মতো। ফলে উপত্যকার ভেতরের নাগরিক জীবন স্বাভাবিক গতিতেই এগিয়ে যাচ্ছিলো। পৃথিবীর কান্না বা অশনি সংকেতকে উপেক্ষা করেই। অবশেষে নভেম্বরের সেই অবশ্যম্ভাবী বুধবারের রাত এলো। গর্জন দিয়ে ঘোষণা করলো পৃথিবীর সমাপ্তি। পর্বতের শরীরের    বরফের দেয়ালগুলো খসে পড়তে লাগলো। অবশেষে জনপদের ভেতরে নেমে এলো কাদামাটি, পাথর আর জলের সম্মিলিত প্রবাহ। যার পার্থিব উদগিরণের নীচে তলিয়ে গেলো সকল কিছু। 

জীবিতরা প্রথম ভয়ের অসাড়তা থেকে মুক্ত হতেই দেখতে পেলো যে, তাদের বাসস্থান, দোকানপাট, মন্দির, তুলা চাষের সাদা প্রান্তর, অন্ধকার কফি বন, চারণক্ষেত্র – সবকিছুই মূহুর্তের ভেতরে অন্তর্হিত হয়ে গেছে। এরও অনেক পরে সৈন্যরা ও স্বেচ্ছাসেবকরা জীবিতদের উদ্ধারের জন্যে আসলো। তারা প্লাবনের বিশালতা মাপা শুরু করলো। সে সময়েই বোঝা গেলো যে, কাদা মাটির তলায় শুয়ে আছে ২০,০০০ মানুষ ও অনির্দিষ্ট সংখ্যক পশু। বিকৃত ও গলিত পচনশীল তরলের নীচে। বন ও নদীগুলোও একই সাথে ভেসে গেছে। বিশাল কাদার এক মরুভূমি ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।

প্রত্যূষের পূর্বে যখন স্টেশন থেকে ডাকা হলো, তখন রলফ কার্লে ও আমি একসাথে ছিলাম। আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় হামাগুড়ি দিয়ে বিছানা থেকে নামলাম এবং কফি তৈরী করতে লাগলাম। রলফ তাড়াহুড়ো করে তার পরিচ্ছদ বদলিয়ে জিনিষপত্র ও সরঞ্জামাদি একটা সবুজ রঙের ব্যাকপ্যাকের ভেতরে ঢুকিয়ে নিলো। সবুজ ব্যাকপ্যাকটা সে আগেও ব্যবহার করেছে। আমরা পরস্পরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালাম, যেমনটা আমরা পূর্বেও জানিয়েছি বহুবার। আমি বিষয়টা সম্পর্কে জানতাম না। সুতরাং কিচেনে বসে কফিতে চুমুক দিয়ে আমি ভাবছিলাম এই দীর্ঘ সময়টা কীভাবে কাটানো যায়। আমি নিশ্চিত যে, সে আগামীকালের পূর্বে ফিরবে না।    

রলফ কার্লে প্রথম ব্যক্তি হিসেবে ঘটনাস্থলে পৌঁছেছিলো। অন্য সকলে যখন জীপ, বাইসাইকেল, পায়ে হেঁটে অথবা অন্য কোনো উপায়ে অকুস্থলে পৌঁছার চেষ্টা করছিলো, তখন রলফ কার্লে টেলিভিশন হেলিকপ্টারে করে কাদামাটির ধ্বসের উপরে পৌঁছে চক্কর দিচ্ছিলো। আমরা টেলিভিশনের পর্দায় তার সহকারীর তোলা ফুটেজগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। রলফকে সেখানে দেখা যাচ্ছিলো  হাঁটু পরিমাণ কাদার ভেতরে দাঁড়িয়ে থাকতে। হাতে একটা মাইক্রোফোন। চারপাশে পাগলাগারদের চিৎকার চেঁচামেচিতে ভরপুর নিমজ্জিত জলাভূমির ভেতরে হারিয়ে যাওয়া শিশু, আহত জীবিত ব্যক্তি বা মৃতদেহ। ধ্বংস স্তুপের ভেতর থেকেও তার শান্ত কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিলো।

বিগত বেশ কয়েক বছর যাবৎ রলফ টেলিভিশনে সংবাদপ্রচারক হিসেবে খ্যাতি লাভ করেছে। অসাধারণ দৃঢ়তা নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র অথবা দুর্যোগস্থল থেকে লাইভ সংবাদ পরিবেশ করে থাকে। এই ধরণের গমণে কোনোকিছুই তাকে থামিয়ে রাখতে পারে না। আমি সকল সময়েই বিস্মিত হই ভীষণ বিপদ বা ভোগান্তির মধ্যেও তার শান্তসমাহিত ভাব দেখে। মনে হয় তার সহিষ্ণুতা বা ঔৎসুক্যকে থামিয়ে দেয়ার মতো কোনো শক্তিই পৃথিবীতে নাই। শঙ্কা তাকে কখনোই স্পর্শ করে না। যদিও সে আমার কাছে স্বীকার করেছে যে, সে আদৌ খুব সাহসী মানুষ নয়। তবে আমি বিশ্বাস করি যে, ক্যামেরার লেন্সের একটা অদ্ভুত প্রভাব তার উপরে আছে। এটা তাকে ভিন্ন কোনো সময়ে নিয়ে চলে যায়। যেখান থেকে সে তার সমস্ত নির্লিপ্ততা দিয়ে ঘটনাপ্রবাহে অংশগ্রহণ না করেই সেগুলোকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে। যখন তাকে আমার আরো বেশী জানার সুযোগ হয়েছিলো, তখনই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, এই কল্পিত দূরত্বই তাকে মানসিক আবেগ/ উত্তেজনা থেকে রক্ষা করে থাকে।

এযুসেনার গল্পের শুরু থেকেই সে উপস্থিত ছিলো। যে স্বেচ্ছাসেবকরা এযুসেনাকে আবিস্কার করেছে  অথবা প্রথম যারা তাকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছে তাদের সবার ছবিই সে তুলে পাঠিয়েছে।  ক্যামেরা জুম করে সে মেয়েটার অন্ধকারাচ্ছন্ন মুখমণ্ডল, বৃহৎ নিঃসঙ্গ চোখ, ভাঁজ করা জট বাঁধানো চুল – সবই আমাদের সামনে এনে তুলে ধরছিলো। মেয়েটার চারপাশের কাদাগুলো ছিলো চোরাবালির মতো। কেউ তার কাছে পৌঁছার চেষ্টা করলেই তার ডুবে যাবার ভয় ছিলো। উদ্ধারকারীদের ছুঁড়ে দেয়া দড়িটা মেয়েটা ধরার কোনো চেষ্টাই করেনি, যতক্ষণ পর্যন্ত না চিৎকার করে তাকে তা ধরতে বলা হয়েছিলো। এই পর্যায়ে কাদার ভেতর থেকে হাত তুলে মেয়েটা একটু নড়ার চেষ্টা করলে তাৎক্ষণিকভাবে আরো কিছুটা ডুবে যায়। রলফ তখন তার ঝোলা ও জিনিসপত্রগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কর্দমাক্ত পঙ্কিলের ভেতরে এগিয়ে যায়। সহকারীর মাইক্রোফোনের দিকে তাকিয়ে বলে যে, জায়গাটা খুবই শীতল এবং সেখান থেকে পচা লাশের গন্ধ বেরুচ্ছে।

“নাম কি তোমার?” সে মেয়েটাকে জিজ্ঞেস করলো। মেয়েটি তার ফুলের নামটা বললো। রলফ তাকে নির্দেশ দিলো, “এযুসেনা, একটুও নড়বে না তুমি।” তারপর মেয়েটার সাথে সে কথা বলতে লাগলো। অনবরত। কোনো চিন্তাভাবনা না করেই। সম্ভবত মেয়েটির মনোযোগকে অন্যত্র সরিয়ে  নিয়ে যাবার জন্যে। একই সাথে সে কাদার ভেতর দিয়ে ধীরে ধীরে মেয়েটার দিকে এগিয়ে লাগলো। শরীর কোমর অবধি ডুবে যাওয়া পর্যন্ত। চারপাশের বাতাসকে রলফের কাছে তখন বিষন্ন ও অস্পষ্ট মনে হচ্ছিলো। চারপাশের কাদার মতো।

ওভাবে মেয়েটার কাছে পৌঁছানো আসলেই অসম্ভব ছিল। সুতরাং রলফ পেছনে ফিরে আসলো এবং কাদার ভেতর দিয়ে মেয়েটার চারপাশ দিয়ে চক্কর দিয়ে লাগলো। এক পাশে পায়ের নীচের মাটিকে কিছুটা শক্ত মনে হলো। এই দিক দিয়েই শেষ পর্যন্ত সে মেয়েটার যথেষ্ট কাছে পৌঁছুতে সক্ষম হলো এবং উদ্ধারকারীদের দড়িটা দিয়ে মেয়েটির বাহুর নীচে বাঁধলো। এটা দিয়ে তাকে টেনে বাইরে আনার জন্যে। কাজ শেষ করার পর সে মেয়েটার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে ভ্রুকুটি করলো। এই সময়ে তাকে আমার কাছে মনে হচ্ছিলো একটা ছোট্ট বালক। মেয়েটাকে সে বললো যে তার আর কোনো অসুবিধা নেই; একটু পরেই তাকে  বের করে আনা হবে। অতঃপর অন্যদেরকে সংকেত দিলো রশিতে টান দিতে। কিন্তু টানের ফলে রশিটা একটু প্রসারিত হতেই মেয়েটা চিৎকার করে উঠলো।  তারা একটু দম নিয়ে পুনরায় চেষ্টা করলো। এবারে কাদার ভেতর থেকে মেয়েটার কাঁধ আর বাহু বেরিয়ে এলেও তাকে আর সরানো গেলো না। তার শরীরটা নীচে কোথাও আটকা পড়েছে। একজন বললো, মেয়েটার পা দুটো সম্ভবত কাদার নীচের কোনো ভেঙ্গে পড়া দেয়ালের মধ্যে আটকে গেছে। কিন্তু মেয়েটা জানালো যে, শুধুমাত্র দেয়ালের ভাঙ্গা ইটপাথরের টুকরা নয়, তার পা দুটো ধরে নীচ থেকে ঝুলে আছে তার ভাইবোনেরা।

“চিন্তা করো না। আমরা তোমাকে এখান থেকে বের করে আনবোই,” রলফ প্রতিজ্ঞা করলো। টেলিভিশন ট্রান্সমিশনের মান ভালো না হলেও আমি স্পষ্ট শুনতে পেলাম রলফের কণ্ঠস্বর ভেঙে যাচ্ছে। চাপা কান্নায়। সেই মূহুর্তে আমি রলফকে পূর্বের যেকোনো সময়ের তুলনায় আরো বেশী ভালোবাসলাম। এযুসেনা তার দিকে তাকালো, কিন্তু কিছুই বললো না। 

রলফ নিজের সমস্ত উদ্ভাবনী ক্ষমতা ব্যবহার করে মেয়েটিকে উদ্ধার করার চেষ্টা চালালো। প্রথমে চেষ্টা চালালো খুঁটি ও রশি দিয়ে। কিন্তু রশিতে একটু টান পড়লেই তা বন্দী হয়ে থাকা মেয়েটির জন্যে অসহ্য রকমের অত্যাচার হয়ে উঠছিল। সুতরাং সে ভিন্নভাবে চেষ্টা করলো। একটা খুঁটিকে সে উত্তোলক দন্ড বা লিভার হিসেবে ব্যবহার করে। কিন্তু কোনো ইতিবাচক ফলাফল এলো না।  অতঃপর উদ্ধার কাজে আসা কয়েকটা সৈনিককে সে বললো তাকে সাহায্য করার জন্যে। কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই তারা চলে গেলো। কারণ আরো অনেক আহত মানুষেরা তাদেরকে সাহায্যের জন্যে ডাকছিলো।

মেয়েটা নড়াচড়া করতে পারছিলো না। শুধুমাত্র শ্বাসপ্রশ্বাস নিতে পারছিলো। তারপরেও কোনো বেপরোয়া আচরণ করছিলো না। কারণ নিয়তির উপরে সে নিজের ভবিতব্যকে ছেড়ে দিয়েছিলো। কিন্তু রলফ দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলো তাকে বাঁচানোর জন্যে। একজন একটা টায়ার নিয়ে আসলো। রলফ সেটাকে লাইফবেল্ট হিসেবে মেয়েটার দুই বাহুর নীচে স্থাপন করে দিলো। একটা তক্তাকে সে গর্তের কাছে স্থাপন করলো, যাতে সে নিজে এর সাথে এঁটে থেকে মেয়েটার কাছাকাছি থাকতে পারে। মেয়েটার চারপাশের ভাঙ্গা ইটপাথরের টুকরাগুলোকে সরানো যাচ্ছিলো না। রলফ দুই একবার চেষ্টা করলো ঘন কর্দমাক্ত জলের ভেতর দিয়ে ডুব দিয়ে মেয়েটার পায়ের কাছে পৌঁছানোর। কিন্তু পারলো না। হতাশ হয়ে মুখ থেকে কাদাতে আবৃত নুড়ি পাথরগুলো ছুড়ে মারলো। থুথু হিসেবে। পরিশেষে সে সিদ্ধান্ত নিলো মেয়েটার চারপাশ থেকে জল সরিয়ে তাকে উদ্ধার করার। এর জন্যে সে রেডিওর মাধ্যমে পাম্প পাঠানোর জন্যে অনুরোধ করে একটা বার্তা পাঠালো। কিন্তু ফিরতি বার্তায় তাকে জানানো হলো যে, পাম্প বহন করে নিয়ে আসার জন্যে কোন বাহন পাওয়া যাচ্ছে না। পাওয়া গেলেও পরেরদিন সকালের পূর্বে তা প্রেরণ করা সম্ভব হবে না।

“অতক্ষণ পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করতে পারবো না!” রলফ চিৎকার করে বললো। কিন্তু  চারপাশের অবিশ্রান্ত কোলাহল আর প্রলাপের মধ্যে কোনো প্রত্যুত্তর এলো না। রলফের কাছে মনে হলো যে সময় আকস্মিকভাবে  থেমে গেছে। এমনকি বাস্তবতাও পরিবর্তিত হয়ে গেছে। এগুলোকে আর কখনোই মেরামত করা সম্ভব হবে না।

একজন সামরিক ডাক্তার এসে পরীক্ষা করে দেখলেন যে, এযুসেনার হার্ট তখনো সচল রয়েছে। রাতের বেলায় যদি তার খুব ঠাণ্ডা লেগে না যায়, তবে সকাল পর্যন্ত সে বাঁচতে পারে। “ঝুলে  থাকো এযুসেনা, আগামীকাল সকালের মধ্যেই পাম্প চলে আসবে,” রলফ তাকে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করলো। “ আমাকে একা রেখে চলে যেয়ো না,” মেয়েটি প্রার্থনার ভঙ্গিতে রলফকে বললো। “ অবশ্যই না। আমি তোমাকে কখনোই ছেড়ে যাবো না, “ সে প্রত্যুত্তর দিলো।

কেউ একজন রলফকে কফি এনে দিলো। মেয়েটিকে সে ছোট ছোট চুমুক দিয়ে তা পান করতে সাহায্য করলো। এই উষ্ণ জল মেয়েটিকে সতেজ করলো এবং সে রলফকে তার ক্ষুদ্র জীবন, তার পরিবার, তার স্কুল এবং আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যূৎপাতের পূর্বে তার জানা পৃথিবী কেমন ছিলো এগুলো সম্পর্কে  গল্প বলতে শুরু করলো। তার বয়স ১৩ বছর এবং সে কখনোই গ্রামের বাইরে যায়নি। রলফ কার্লে এই সময়ে তার অকালপক্ক দূরাশা  দিয়ে কল্পনা করতে লাগলো যে, সবকিছুই ভালোভাবে শেষ হবে।  সকালে পাম্প আসবে।  তারা জল সরিয়ে ফেলবে।  এযুসেনাকে সে উদ্ধার করে হেলিকপ্টার দিয়ে দূরবর্তী কোনো হাসপাতালে নিয়ে যাবে। সেখানে সে দ্রুত আরোগ্য লাভ করবে। রলফ তাকে দেখতে গিফট নিয়ে যাবে। এবং সে ভাবলো, এযুসেনা ইতিমধ্যেই পুতুল খেলার বয়স অতিক্রম করেছে। আমি জানি না কোন ধরণের গিফট তাকে খুশী করবে; পোশাকও হতে পারে। মেয়েদের সম্পর্কে আমি খুব বেশী জানি না, এমন একটা উপসংহারে উপনীত হলো সে। এবং খুবই অবাক হলো এ’কারণে যে, জীবনে অনেক নারীর সাথে তার পরিচিতি থাকলেও এই সমস্ত বিষয় নিয়ে বিস্তারিতভাবে তাকে কেউ কোনোদিন বলেনি। সময় পার করার জন্যে সে এযুসেনাকে নিজের গল্প বলতে শুরু করলো। খবর সংগ্রহ করার উদ্দেশ্যে ভ্রমণ আর এডভেঞ্চারের গল্প। গল্পের মজুদ শেষ হয়ে যাবার পর সে নিজের কল্পনা থেকে তাকে আরো গল্প শোনাতে লাগলো। তাকে আনন্দ দেয়ার জন্যে।

অনেক সময়েই  এযুসেনা তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছিলো। কিন্তু রলফ অন্ধকারের ভেতরে তার গল্প বলেই যাচ্ছিলো। শুধুমাত্র তাকে নিশ্চিত করার জন্যে যে, সে তাকে ছেড়ে চলে যায়নি এবং পরেরদিন সকালেই সে তাকে এই অনিশ্চিত অবস্থা থেকে মুক্ত করবে।   

শত মাইল দূর থেকে টেলিভিশনের পর্দায় আমি রলফ কার্লে ও এযুসেনাকে দেখছিলাম। বাসায়  একদমই ভালো লাগছিলো না। সুতরাং জাতীয় টেলিভিশন অফিসে গেলাম। ইতিপূর্বেও রলফ আর আমি এখানে অনেক বিনিদ্র রজনী যাপন করেছি। বিভিন্ন প্রোগ্রাম সম্পাদনার জন্যে। এখানে  আগমণের পর নিজেকে রলফের নিকটে বলে মনে হচ্ছিলো। অনুভব করতে পারছিলাম তিন দিনের চরম উৎকণ্ঠার দিনগুলোতে সে কেমনভাবে বাঁচছিলো।

নগরের সকল গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের সাথে সাক্ষাৎ করলাম। সিনেটর, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধাণ, উত্তর আমেরিকার রাষ্ট্রদূত, এমনকি ন্যাশনাল পেট্রোলিয়ামের প্রেসিডেন্টের সঙ্গেও। তাদের কাছে আমি বিনীতভাবে  করজোড়ে অনুরোধ করলাম পাম্প মেশিন দিয়ে কাদাগুলোকে সরানোর জন্যে। কিন্তু সবার কাছ থেকেই শুধুমাত্র অস্পষ্ট  প্রতিশ্রুতি পেলাম। অতঃপর রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে জরুরী সাহায্যের জন্যে আবেদন করলাম। দেখার জন্যে যে, এমন কেউ বাকী রয়ে গেছে কিনা যে আমাদেরকে সাহায্য করতে সক্ষম।

ফাঁকে ফাঁকে আমি নিউজ রুমে দৌড়ে যেতাম। উপগ্রহের মাধ্যমে পাঠানো দুর্যোগের খবরের আপডেট বা বিস্তারিত দেখার জন্যে। খবরের প্রতিবেদকেরা ছবি ও ভিডিও সহকারে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো প্রচার করছিলো। কিন্তু আমার নজর ছিলো শুধুমাত্র এযুসেনার কাদার কুয়া বা গর্তটির দিকে। টেলিভিশনের পর্দা দুর্যোগকে আমার সাথে এক সমতলে এনে দিলেও রলফ ও আমার মধ্যকার দূরত্বকে বাড়িয়ে দিচ্ছিলো। তারপরেও আমি তার সঙ্গেই ছিলাম। বাচ্চা মেয়েটির সকল ভোগান্তিই আমাকে স্পর্শ করছিলো, যেমনভাবে তা রলফকে ব্যথিত করছিলো। রলফের সাথে যোগাযোগ করার অসম্ভাব্যতার মুখোমুখি হবার পর মনে হচ্ছিলো মনের জোর দিয়ে আমি যদি তার কাছে পৌঁছে যেতে পারতাম! সেজন্যে আমি আত্নসম্মোহনের চেষ্টাও করলাম। কিন্তু সবকিছুই শেষ পর্যন্ত উন্মাদনা ও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হলো। কিছু কিছু সময়ে উচ্চস্বরে কেঁদে নিজেকে হালকা করার চেষ্টা করতাম। অন্য সময়ে আমি এতোটাই নিস্তেজ হয়ে পড়তাম যে, মনে হতো লক্ষ লক্ষ বছর ধরে আমি দূরবীনের ভেতর দিয়ে মৃত কোনো নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে রয়েছি।

সকালের সংবাদ ব্রডকাস্টের সময়ে দেখা গেলো মানুষ এবং পশুদের মৃতদেহগুলো রাতারাতি বরফ গলে নদী হয়ে যাওয়া উপত্যকার ভেতর দিয়ে ভেসে আসছে।  কাদার উপর দিয়ে একবার উঠে আসলো একটা  গাছের চূড়া এবং একটা মন্দিরের বেল টাওয়ার।  উপরে কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছিলো। তারা প্রবল ধৈর্যসহকারে উদ্ধারকারী জন্যে অপেক্ষা করছিলো। শত শত সৈনিক ও সিভিল ডিফেন্সের   স্বেচ্ছাসেবীরা আবর্জনার স্তুপ সরিয়ে জীবিতদের অনুসন্ধান করছিলো। এদের সমান্তরালে  লম্বা লম্বা সারিতে দাঁড়িয়ে জীর্ণ-শীর্ন মৃত অপচ্ছায়ারা অপেক্ষা করছিলো উষ্ণ কাপের ঝোল বা স্যুপের জন্যে। রেডিও নেট ওয়ার্ক থেকে ঘোষণা এলো যে, এতিম শিশুদের জন্যে আশ্রয় প্রদাণকারীদের নিকট হতে অসংখ্য  কলের কারণে সরকারী টেলিফোনগুলো জ্যাম হয়ে গেছে। পান করার জল ছিলো খুবই অপ্রতুল। খাবার ও গ্যাসোলিনও। চিকিৎসকরা এনাসথেশিয়ার অভাবে হাত ও পা অস্ত্রোপচার করা বন্ধ করে দিয়েছিলো। তারা দাবী করছিলো যে অন্তত তাদেরকে ব্যাথানাশক ও এন্টিবায়োটিক সরবরাহ করা হোক। প্রায় সকল চলার পথগুলোই আমলাতান্ত্রিক প্রতিবন্ধকের চেয়েও অনতিক্রম্য হয়ে গিয়েছিলো। সর্বোপরি, পচনশীল মৃতদেহগুলো কাদার সাথে মিশে জীবন্ত মানুষদের জন্যে মহামারী প্রাদুর্ভাব সৃষ্টি করছিলো।

এযুসেনা যে টায়ারটি কাদার উপরে তাকে ধরে রেখেছিলো, তার ভেতরেই কাঁপছিলো। মানসিক অস্থিরতা ও নড়তে না পারার কারণে সে খুবই দুর্বল হয়ে গিয়েছিলো। কিন্তু সে তখনো জ্ঞান হারায়নি এবং মুখের কাছে মাইক্রোফোন ধরলে তাকে তখনো শোনা যাচ্ছিলো। তার কন্ঠস্বর ছিলো খুবই মৃদু। যেনো সে সকলের অসুবিধা করার জন্যে ক্ষমা চাচ্ছিলো। রলফের মুখে দাঁড়ি গজিয়ে গিয়েছিলো এবং তার চোখের নীচে কালো বলিরেখা দেখা যাচ্ছিলো। তাকে মনে হচ্ছিলো খুবই ক্লান্ত। এমনকি এতো দূর থেকেও আমি তার উদ্বিগ্নতা অনুভব করতে পারছিলাম। তার এই উদ্বিগ্নতা অন্য যেকোন এডভেঞ্চার পরবর্তী ক্লান্তির চেয়ে ভিন্নতর ছিলো। সে ক্যামেরার কথা সম্পূর্ণরুপে বিস্মৃত হয়ে গিয়েছিলো। মেয়েটার দিকে আর কখনোই ক্যামেরার লেন্সের মধ্য দিয়ে তাকাচ্ছিলো না। যে ছবিগুলো আমরা পাচ্ছিলাম সেগুলো তার সহকারীর তোলা ছিলো না। সেগুলো ছিলো অন্য প্রতিবেদকদের। এরা এযুসেনাকে ঘিরেছিলো তার কর্তৃক হৃদয়স্পর্শী  দায়িত্ব সহকারে সেখানকার ঘটে যাওয়া আতংককে মূর্ত করে তোলার জন্যে।

সুর্যোদয়ের পর রলফ পুনরায় চেষ্টা করলো এযুসেনার চারপাশের প্রতিবন্ধতকতাগুলোকে সরিয়ে দেয়ার। কিন্তু নিজের হাত ছাড়া তার আর কোনো সাহায্যকারী ছিলো না। সে কোনো সরঞ্জামও ব্যবহার করার সাহস পাচ্ছিলো না। এযুসেনাকে আহত করার ভয়ে। এযুসেনাকে সে  এক কাপ যবের জাউ ও কলা  খেতে দিলে তাৎক্ষণিকভাবে সে সেটাকে বমি করে দিলো। ডাক্তার জানালো যে সে জ্বরে ভুগছে। এটাও বললো যে এযুসেনার ব্যাপারে তার আর করার কিছু নেই; কারণ  এন্টিবায়োটিক গুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে গ্যাঙ্গরিনের রোগীদের জন্যে। কুমারী মেরির মেডেল পরিহিত একজন ধর্মযাজকও আসলেন এবং এযুসেনাকে আশির্বাদ করে গেলেন।

বিকেলের দিকে গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টি শুরু হলো। এযুসেনা বিড়বিড় করে বলে উঠলো, ”আকাশ কাঁদছে” এবং নিজেও সে কেঁদে উঠলো। “ভয় পেয়ো না,” রলফ তাকে অনুনয় করে বললো। “তোমাকে মনের শক্তি ধরে রাখতে হবে এবং শান্ত থাকতে হবে। সবকিছুই ঠিক হয়ে যাবে। আমি তোমার সাথেই আছি এবং তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবোই।“  প্রতিবেদকেরা এযুসেনার ছবি তোলার জন্যে পুনরায় ফিরে এলো এবং বার বার তাকে একই প্রশ্ন করতে লাগলো। এর কোনোটাতেই এযুসেনা আর কখনোই চেষ্টা করলো না উত্তর দেয়ার।

এরই মধ্যে আরো টেলিভিশন এবং মুভি তৈরীর দল  আসলো লম্বা ক্যাবলের কাটিম ( spool), টেপ, ফিল্ম, ভিডিও,  প্রিসিশন লেন্স, সাউন্ড কনসোল, উজ্জ্বল বাতি,  প্রতিফলনকারী স্ক্রিন, অক্সিলারী মোটর, খাবারের কার্টন, বৈদ্যুতিক মিস্ত্রি এবং ক্যামেরাম্যান ইত্যাদি নিয়ে। এযুসেনার মুখমন্ডল পৃথিবীর লক্ষ লক্ষ টেলিভিশনের পর্দায় জ্বল জ্বল করতে লাগলো। এই পুরো সময়টাতেই রলফ সবার কাছে একটা পাম্প মেশিনের জন্যে অনুনয় করতে লাগলো। উন্নত প্রাযুক্তিক সুবিধাগুলো সত্যিই ভালো ফলাফল বয়ে আনলো। জাতীয় টেলিভিশন উজ্জ্বল ছবি ও স্পষ্ট ছবি প্রচার করতে শুরু করলো। মনে হলো সবকিছুর মধ্যে আকস্মিক কোনো কারণে দূরত্ব কমে গেছে। আমার নিজের কাছেও মনে হচ্ছিলো এযুসেনা আর রলফ আমার পাশেই আছে। আমাদের মাঝখানে শুধুমাত্র একটা  দূর্লঙ্ঘনীয় অপ্রবেশ্য কাঁচের দেয়াল।

আমি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ঘটনাপ্রবাহ অনুসরণ করতে পারছিলাম।  প্রতিক্ষণেই জানতাম যে আমার ভালোবাসা মেয়েটাকে বন্দীদশা থেকে মুক্ত করার ও তার ভোগান্তি কমানোর জন্যে কী প্রাণান্তকর চেষ্টাই না করছে! অন্যদের কথাবার্তাও শুনতে পাচ্ছিলাম; তারা কী বলছিলো। বাকীটা অনুভব করে নিচ্ছিলাম। আমি দেখতে পেলাম এযুসেনা রলফকে শেখাচ্ছে কীভাবে প্রার্থনা করতে হয়। আর রলফ তাকে আরব্য উপন্যাসের ‘এক হাজার এক রজনী’র গল্প বলে তার মনোযোগকে অন্যত্র সরানোর চেষ্টা করছে। এই গল্পগুলো আমি রলফকে আমাদের সাদা মশারীর নীচে শুয়ে শুয়ে বলেছিলাম।  

দ্বিতীয় দিনের শেষে সন্ধ্যার অন্ধকার নেমে আসলো। রলফ একটা অস্ট্রিয়ান লোকসঙ্গীত গেয়ে এযুসেনাকে ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করছিলো। এই গানটা তার নিজের মায়ের কাছ থেকে শেখা। কিন্তু এযুসেনা তখন ঘুম নামক পার্থিব বিষয়ের উর্ধ্বে। ক্ষুধা ও ক্লান্তির কারণে দুজনেই ভীষণ অবসন্ন। তবুও প্রায় অবচেতনের ভেতরে সারারাত ধরে তারা পরস্পরের সাথে কথা বলছিলো।  ঠান্ডায় কাঁপতে কাঁপতে। এই রাতেই রলফের জীবনে এক অত্যাশ্চর্য ঘটনা ঘটে গেলো। অকস্মাৎ নিজের দূর-শৈশব স্মৃতিতে প্রবেশ/নির্গমনের রুদ্ধ দ্বারগুলো খুলে গেলো এবং নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতো প্রবল প্রবাহের সাথে বিস্মৃতির আড়ালে লুকিয়ে থাকা অতীত স্মৃতির স্তরগুলো বেরিয়ে আসতে লাগলো। এমনকি যে প্রতিবন্ধকতাগুলো তার চেতনাকে এতোকাল যাবৎ  রুদ্ধ করে রেখেছিলো, সেগুলোও এই প্লাবনের তোড়ে মসৃণ ও সমতল হয়ে মিলিয়ে গেলো।

এই অত্যশ্চর্য ঘটনার সবকিছুকেই রলফের পক্ষে এযুসেনার কাছে প্রকাশ করা সম্ভব ছিলো না। কারণ, এযুসেনা হয়তো জানতোই  না যে, সময় বা সমুদ্রের অপর তীরেও পৃথিবী বলে একটা জগত আছে। অথবা তার পক্ষে যুদ্ধের সময়ে ইউরোপ কেমন ছিলো, তাও চিন্তা করা সম্ভব ছিলো না। সুতরাং নিজেদের পরাজয়ের গল্প এবং কেমন করে রাশিয়ানরা তাদেরকে ক্ষুধায় মৃত বন্দীদেরকে কবর দেয়ার জন্যে তাদেরকে কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়েছিলো – সেই গল্পগুলো এযুসেনাকে  শোনাতে সে সক্ষম হলো না। সে ভেবেই পেলো না, কীভাবে সে তাকে বলবে যে, উলংগ মানুষদের মৃতদেহগুলোকে পর্বতের মতো উঁচু করে স্তূপীকৃত করে রাখা হয়েছিলো। যাদেরকে দূর থেকে দেখতে মনে হতো জ্বালানীকাঠ। অথবা কীভাবে তাকে সে বলবে শিশুদের কথা, যাদেরকে প্রজ্বলিত চুলা আর ফাঁসিকাঠের দিকে ঠেলে দেয়া হয়েছিলো! সেই রাতের কথাও তাকে সে  বললো না, যে রাতে সে নিজের মাকে উলংগ অবস্থায়  লাল বুটের নীচে পদদলিত হয়ে লজ্জায় আর অপমানে কাঁদতে দেখেছিলো। তবে এযুসেনাকে অনেককিছু বলতে না পারলেও রলফ অনুভব করতে পারছিলো যে স্মৃতি তাকে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছে সেই অতীতে, যা একসময়ে সে সচেতনভাবে ভুলে গিয়েছিলো।

এযুসেনাও তার সমস্ত ভয় ও ভার রলফের উপরে ছেড়ে দিয়েছিলো এবং রলফ বাধ্য হচ্ছিলো সেগুলোর মুখোমুখি হতে। সুতরাং, যে নারকীয় যন্ত্রনার ভেতরে তার শৈশব কেটেছিলো, তার স্মৃতি  অকস্মাৎ তাকে আক্রমণ করে বসলো। সে ফিরে গেলো এযুসেনার বয়সে। নিজেকে আবিষ্কার করলো একটা কূপের ভেতরে যেখান থেকে পালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিলো না। যেখানে জীবন্ত অবস্থায় তাকে কবর দেয়া হয়েছিলো। সেই কূপের মধ্য হতে এযুসেনার মতোই তার মাথা কোনোমতে ভূমির উপরে জেগে ছিলো। মাথার কাছেই তার পিতার পা ও জুতোকেও দেখতে পেলো সে। দেখলো তার পিতা নিজের কোমরবন্ধনী খুলে বাতাসের ভেতরে অবিশ্রান্ত কষাঘাত করছেন এবং সাপের মতো ফনা তুলে হিসহিস করছেন। ভয় রলফকে আচ্ছন্ন করে ফেললো।  এই ভয়টাই এতোদিন তার মনের ভেতরে সুপ্ত হয়ে ছিলো। সে নিজেকে পুনরায় আবিষ্কার করলো একটা আলমারীর ভেতরে, যেখানে তার পিতা তাকে তালাবদ্ধ করে রাখতেন। অশোভন আচরণ করার অভিযোগে। অনন্ত সময়ের জন্যে। সেখানে সে উপুড় হয়ে চোখ বন্ধ করে থাকতো, যাতে সে অন্ধকার দেখতে না পায় এবং দুই হাত দিয়ে কান ঢেকে রাখতো, যাতে সে নিজের হৃদয়ের কম্পন না শুনতে পায়, যা  কোণঠাসা পশুর মতো অস্থির হয়ে উঠছিলো। এই সময়েই স্মৃতির ভেতরে ঘুরতে ঘুরতে সে নিজের বোন ক্যাথারিনাকে আবিষ্কার করলো। খুবই মিষ্টি অথচ প্রতিবন্ধী শিশু। সে তার জীবনের পুরো সময়টাই লুকিয়ে পার করেছিলো শুধুমাত্র এই আশায় যাতে তার পিতা তার জন্মানোর লজ্জাকে  ভুলতে পারেন। ক্যাথারিনাকে সাথে নিয়ে রলফ প্রায়শই ডাইনিং টেবিলের নীচে হামাগুড়ি দিয়ে প্রবেশ করতো। সেখানে লম্বা সাদা টেবিলক্লথের আড়ালে পিতার পদশব্দের ভয়ে ভীত দুই শিশু পরস্পরকে জড়িয়ে থাকতো। ক্যাথারিনার গায়ের গন্ধ তার নিজের ঘামের সাথে মিশে যেতো। আরো মিশতো রান্না করা খাবার, আদা, রসুন, সদ্য ভাঁজা পাউরুটি ও স্যুপের গন্ধ এবং এক অনাকাঙ্ক্ষিত পচনশীল কাদার গন্ধ।

রাতে রলফের নিকটে ক্যাথারিনা পুনরায় বাস্তব হয়ে ফিরে এলো। ভীতসন্ত্রস্ত এযুসেনার হাতকে নিজের হাতের ভেতরে স্থাপন করে সে তার রেশমের মতো মসৃণ চুলকে নিজের গালের সাথে ঘষতে ঘষতে রলফ ক্যাথারিনার চোখের উজ্জ্বল দৃষ্টিকে অনুভব করতে সক্ষম হলো। অন্ধকারের ভেতরে টেবিলক্লথের আড়ালে ক্যাথারিনা শিশু হয়ে পুনরায় এলো এবং একসময়ে পতাকার মতো বাতাসের মধ্যে উড়তে থাকলো। অনেক বছর পরে রলফ তার বোনের মৃত্যুর জন্যে কাঁদতে পারলো এবং তাকে ছেড়ে চলে আসার জন্যে দুঃখিত হলো। সে বুঝতে পারলো যে, প্রতিবেদক হিসেবে তার যে সকল কীর্তি তাকে খ্যাতি এনে দিয়েছে, সেগুলো ছিলো তার শিশুকালের ভয়কে দূরে রাখার চেষ্টা প্রসূত। প্রতিবেদক হিসেবে লেন্সের পেছনে আশ্রয় নেয়া মূলত ছিল তার একটা কৌশল, যেখান থেকে বাস্তবতাকে সহনীয় হিসেবে অনুভব করার চেষ্টা করতো। সাহসিকতার অনুশীলন হিসেবে সে অনেক বেশি ঝুঁকি নিতো এবং নিজেকে প্রশিক্ষণ দিতো কীভাবে ভয়ের দানবগুলোকে জয় করা যায়। কারণ এগুলো তাকে রাতের অন্ধকারে যন্ত্রণা দিতো। কিন্তু এখন সে সত্যের মুখোমুখি; অতীত থেকে আর পলায়ন সম্ভব নয়। নিজেই এখন এযুসেনা। কাদার ভেতরে আকন্ঠ নিমজ্জিত হয়ে আছে। তার ভয় কোনোভাবেই ভুলে যাওয়া শৈশবের কোনো আবেগ নয়।  অশ্রুজলের ভেতরে সে দেখতে পেলো তার মাকে। তিনি কালো পোষাক পরে আছেন। তার কন্ঠ থেকে বুকের উপরে ঝুলছে একটি ইমিটেশনের তৈরী পকেটবুক। ঠিক যেমনটি তাকে সে শেষবার দেখেছিলো জাহাজের ডকের উপরে। যখন তিনি তাকে দক্ষিণ আমেরিকাতে যাওয়ার নৌকায় তুলে দিতে এসেছিলেন। তিনি আজ রলফের কান্না থামাতে আসেননি। তিনি বলতে এসেছেন যে, যুদ্ধ শেষ। রলফ হাতে শাবল তুলে নিয়ে তাদেরকে যেনো সমাধিস্থ করে। 

“কেঁদো না। আমি তোমাকে আর কষ্ট দেবো না। আমি ভালো আছি,” এযুসেনা বললো যখন সকাল হলো।  “আমি তোমার জন্যে কাঁদছি না,” রলফ মৃদু হেসে বললো। “আমি কাঁদছি নিজের জন্যে।“

দুর্যোগের সেই উপত্যকার ভেতরে ঝড়ের মেঘমালার ভেতর দিয়ে বিষন্ন আলো দিয়ে তৃতীয় দিবসের সকাল শুরু হলো। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট পরিদর্শন করতে আসলেন। কাটছাঁট সাফারি জ্যাকেট পরে। ধারণা দিলেন যে, এটাই শতাব্দীর  সবচেয়ে খারাপ দুর্যোগ ছিলো। জানালেন যে,  সারাদেশে শোক ঘোষণা করা হয়েছে, প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে সাহায্যের প্রস্তাব এসেছে এবং তিনি দেশে আপৎকালীন জরুরী অবস্থা ঘোষণা করেছেন । তিনি আরো জানালেন যে, সশস্ত্র বাহিনী আইন শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে কঠোর আচরণ করবে।  চুরি অথবা অন্য কোনো অপরাধের সাথে যেই যুক্ত হবে তাদেরকে দেখামাত্রই গুলি করা হবে। তিনি আরো উল্লেখ করলেন যে, সকল মৃতদেহ সরিয়ে ফেলা বা তাদের পরিসংখ্যান নেয়া অসম্ভব। সুতরাং এই উপতক্যাকে পবিত্র ভূমি বলে ঘোষণা দেয়া হবে। ধর্মযাজকগণ এসে সকল মৃতদের জন্যে গায়েবী প্রার্থনা করবেন। তিনি সামরিক বাহিনীর মাঠে স্থাপিত তাবুগুলোতে গেলেন উদ্ধারকৃতদেরকে সান্তনা দিয়ে বলার জন্যে যে, তাদের জন্যে রিলিফের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। তিনি অস্থায়ীভাবে স্থাপিত হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সদেরকে ধন্যবাদ জ্ঞাপনের জন্যে পরিদর্শন করতে গেলেন। কারণ তারা অক্লান্ত পরিশ্রম করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো। এরপর তিনি তাকে এযুসেনার কাছে নিয়ে যেতে বললেন, যে ছোট্ট শিশুটিকে সারা পৃথিবী দেখেছে। এযুসেনার দিকে ঝানু রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে প্রেসিডেন্ট হাত নাড়লেন। মাইক্রোফোনগুলো  তাঁর আবেগী কণ্ঠস্বর ধারণ করলো। তিনি অভিভাবকের সুরে তাকে জানালেন যে, তার সাহস রাষ্ট্রীয় উদাহরণ হয়ে থাকবে। রলফ কার্লে তাকে পাম্প মেশিনের জন্যে অনুরোধ করলো। তিনি তাকে নিশ্চিত করলেন যে, তিনি ব্যক্তিগতভাবে নিজে বিষয়টা দেখবেন।

আমি কয়েক মূহুর্তের জন্যে কাদার গর্তের পাশে রলফকে দেখতে পেলাম। বিকেলের টেলিভিশনেও তাকে আমি একই স্থানে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলাম। গণকেরা যেমন করে তাদের স্ফটিকবলের সাথে লেগে থাকে, তেমনি করে আমি টেলিভিশনের পর্দার সাথে লেগে রইলাম। আমি রলফের ভেতরে কিছু মৌলিক পরিবর্তন লক্ষ্য করলাম। আমি জানতাম যে, বিগত রাতে তার মনের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছে। সে বেদনায় ভেসে যাচ্ছে এবং যেকোন সময়েই তার অবস্থা জীবনের জন্যে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যেতে পারে। মেয়েটা তার সেই অংশটা স্পর্শ করেছে, যেটাতে তার প্রবেশাধিকার ছিলো না। এই অংশ নিয়ে আমার সাথেও কখনো সে শেয়ার করেনি। রলফ এযুসেনাকে সান্তনা দিতে চেয়েছিলো, কিন্তু এযুসেনাই শেষ পর্যন্ত তাকে সান্তনা দিয়েছে।

আমি যথাযথভাবে সনাক্ত করতে সক্ষম হয়েছলাম ঠিক কোন মূহূর্তে রলফ তার যুদ্ধ ছেড়ে দিয়ে নিজেকে সমর্পন করেছিলো চেয়ে চেয়ে মেয়েটার মৃত্যু দেখার। তিনদিন এবং  দুইরাত আমি  তাদের সাথে ছিলাম। জীবনের অন্য প্রান্ত থেকে তাদের উপরে গোয়েন্দাগিরি করছিলাম। আমি সেখানে ছিলাম যখন এযুসেনা তাকে বলেছিলো যে, তার তেরো বছরের জীবনে কোনো ছেলেই তাকে ভালবাসেনি এবং পৃথিবী থেকে ভালোবাসা ছাড়া চলে যাওয়া আসলেই দুঃখের। রলফ তাকে নিশ্চিত করেছিলো যে, সে তাকে পৃথিবীর যে কারো চেয়ে বেশি ভালোবাসে। নিজের মা, বোন এবং যে সকল নারীরা তাকে ভালোবেসেছে তাদের চেয়েও। এমনকি আমার চেয়েও। আমি তাকে দেখেছিলাম তার শীর্ণ কপালকে চুমু খেতে। মিষ্টি অথচ বেদনার্ত আবেগ নিয়ে, যেটার নাম সে জানতো না। আমি অনুভব করেছি সেই মূহূর্তে কীভাবে তারা বেদনা থেকে মুক্তি লাভ করেছিলো, কীভাবে তারা শকুন ও হেলিকপ্টারগুলোর উর্ধ্বে উঠেছিলো,  কীভাবে  বিশাল দুর্নীতি আর কপট শোকের উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিলো, এবং কীভাবে তারা অবশেষে মৃত্যুকে মেনে নিয়েছিলো। আমি জানতাম যে, রলফ কার্লে নিঃশব্দভাবে প্রার্থনা করছিলো, যাতে এযুসেনা তাড়াতাড়ি   মরে যায়। কারণ তার কষ্ট সহ্য করার মতো ছিলো না।

শেষ পর্যন্ত আমি একটা পাম্প সংগ্রহ করতে সমর্থ হয়েছিলাম। একজন জেনারেলের সাথেও যোগাযোগ করেছিলাম যিনি রাজী হয়েছিলেন পরেরদিন সামরিক কার্গো প্লেন দিয়ে সেটাকে ঘটনাস্থলে পাঠানোর। কিন্তু তৃতীয় দিনের রাতে কোয়ার্টয বাতি ও শত শত ক্যামেরা লেন্সের নীচে এযুসেনা হাল ছেড়ে দিলো। শেষ মুহুর্তে তার দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিলো যারা তাকে তার শেষ সময় পর্যন্ত বেঁচে থাকতে সাহায্য করেছিলো। রলফ কার্লে তার লাইফ বেল্টটা তার বাহুর নীচ থেকে সরিয়ে নিয়েছিলো, তার চোখের পাতাদুটোকে বন্ধ করে দিয়েছিলো, তাকে নিজের বুকে ধারণ করেছিলো কিছুক্ষণ এবং অবশেষে তাকে চলে যেতে দিয়েছিলো। ধীরে ধীরে কাদার নীচে ডুবে গিয়েছিলো মেয়েটি। একটা ফুলের মতো।     

তুমি আমার কাছে ফিরে এসেছো, কিন্তু তুমি আগের মানুষটি নও। আমি তোমাকে প্রায়ই টেলিভিশন স্টেশনে সাথে করে নিয়ে যাই। সেখানে আমরা এযুসেনার ভিডিওটি বার বার দেখি। তুমি খুব গভীরভাবে সেগুলোকে নিরীক্ষণ করো, যেনো তুমি কিছু একটা অনুসন্ধান করছো যা দিয়ে তাকে বাঁচানো যেতো। যেটার কথা সেই সময়ে ভাবো নাই। অথবা এমনও হতে পারে যে, তুমি নিজেকেই দেখার চেষ্টা করো, যেমন করে মানুষ আয়নায় নিজেকে দেখে। উলংগ মানুষ হিসেবে। তোমার ক্যামেরাটি ক্লোজেটের ভেতরে বাক্সবন্দী হয়ে পড়ে আছে। সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে। তুমি আর লেখো না অথবা গান করো না। সারাদিন ধরে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে থাকো। পর্বতের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে। তোমার পাশে আমি অপেক্ষা করি নিজের ভেতরে তোমার ভ্রমণ শেষ হবার। পুরনো ঘা শুকানোর। আমি জানি যখন তুমি দুঃস্বপ্ন থেকে ফিরে আসবে, তখন আমরা দুজনে আবার হাঁটবো। হাতে হাত রেখে। আগের মতো। 

সর্বশেষ
জনপ্রিয়