ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

ছোটগল্প: সোনার পাথরবাটি (চতুর্থ পর্ব)

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশিত: ১২:২৭, ২৯ অক্টোবর ২০২২  

প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

: একদিন নিয়ে আসিস্, বুঝিয়ে বলবো। অন্য কেউ চোখে আঙুল দিয়ে দেখালে কাজ হয়।

: অরে না, এই বয়সে বোঝাতে গেলে কি ভাববে? আর তার দরকারই কি? জানিস্ এই মানুষটাই জোয়ানকালে আমাকে জান দিয়ে আগলে রাখত। একটু ভারী কাজ করতে দেখলে আমাকে সরিয়ে নিজে করত! আরে ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে আমরা ক্লাসমেট ছিলাম! তখনকার প্রেমের ঠোলা দেখিলে তুইও পাগল হয়ে যেতি!

: তোরা সমবয়সী বলেই তো আচরণ একটু ওরকম হয়। তবু তুই একদিন সাথে করে নিয়ে আসিস আপা। বোঝানোর দরকার আছে! আর বোঝাবো, মানে, শিশুদের যে ভাবে বোঝায় মাস্টারেরা, সেভাবে বোঝাবো না কি? তোরাই তো বলিস্, আমার কথা নাকি কথা কথাশিল্পীর মতো…।

: সব কথা শুনতে ভাল হলেই যে সব কথার ফল ভাল হবে, তা নয় রে! এই যে তুই এত কথা বলছিস্, শুনতে সব ভাল লাগছে। কিন্তু ফলাফল কি হয়, আমার কিন্তু একটু ভয়ও হচ্ছে। কারণ সব কদর্য সর্বনাশগুলো সুন্দর পথ ধরেই আসে।

:শোন সুরমা আপা, শুধু বিপরীত চিন্তা করিস না! আজ থেকেই তাকে বাগে আনার চেষ্টা করবি। তার পছন্দের কিছু নাস্তা বানিয়ে ভ্যানিটি ব্যাগে ভরে বলবি, আমার কাছে কখানা গহনা আছে। আমি গোপনে গড়িয়েছি। তোমাকে বাইরে নিয়ে দেখাব। তারপর কোনো পার্কে একটি চাদর বিছিয়ে কড়া করে দুধ জ্বাল দেয়া ঘন চা বের করে দিবি! তারপর একে একে যা নাস্তা বানিয়েছিস্, তা বের করে দু’জনে খুঁটে খুঁটে খেতে থাকবি।

: গহনা ক’খানা দেখতে চাইলে কী বলব, তাই বল?

: গাঢ়ো চোখে তখন তাকিয়ে বলবি, আরে আমিই তো তোমার আস্ত সোনা! বলবি, বেঁচে আছি তো, তাই বোঝো না! মরলে, গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে যে ভাবিদের সাথে সাথে হেসে হেসে কথা বলো, ফোন এলে আমার কাছ থেকে উঠে বারান্দায় যাও, তুমি মরলেও ওদের কিছু যায় আসে না। আর আমি মরলে ভাবিরা-আপারা সব পালাবে। কারণ, তখন ভাববে মাথা গরম করে কোনটাকে আবার জাপটে ধরো!

: আরো কিছু শিখিয়ে দে!

: আরো? বেশি ঝাঁঝ দেখালে বলবি, জোয়ানকালে তো তুমি আমাকে ভালবেসে বাড়িটি একা আমার নামে 
কিনেছিলে। আমি তা চার ছেলেমেয়ের নামে সমান ভাগ করে রেজিষ্ট্রী করে দিয়েছি। আমি মরলে যে চার আনা ফেরত পেতে, তাও তোমার অফেরতযোগ্য! ভালভাবে বাঁচতে চাইলে আমাকে বাঁচাও। কোরবানীর গরুর মতো নাইয়ে পুঁছিয়ে রাখো!

: কিন্তু ছেলেমেয়েদের নামে তো বাড়ি লিখে দিইনি?

: মিথ্যে কথা বলবি…। ছেলেমেয়েকে শিখিয়ে দিবি তোকে সহযোগিতা করতে! মা-বাবার ভেতর মিল না থাকলে সংসার পুরোই নরক!

: হা হা হা…।
উচ্চস্বরে হাসতে হাসতে সুরমা দ্রুত বেরিয়ে যায় বিদায়ের সময় অনেক আগে পার হয়ে যাওয়াতে। দরজার বাইরে গিয়ে লিফটের বোতাম টিপে আবার ছুটে এসে নেবুলার মাথাটা নিজের বুকের ভেতর টেনে নিয়ে জোরছে এক চাপ দিয়ে বলে ‘তোর ভেতর প্রচণ্ড একটি মা মা ভাব আছে। যা কামুক পুরুষকে আকর্ষণ করবে না। আকর্ষণ করবে যারা স্নেহের কাঙাল, ক’দিন দেখে তোকে বুঝবে, তাদেরকে…। বুঝলি? কথাটা মনে রাখিস…!’
কথা শেষ না হতে হতে লিফট এসে পড়লে সুরমা ক্ষীপ্র বেগে তাতে ঢুকে পড়ল। লিফটের দরজা বন্ধ হতে হতে নেবুলা সুরমার কাশতে কাশতে হাসির গমকও শুনতে পায়…।

দুই.
বিজ্ঞাপণ দিয়েছিল নেবুলা প্রায় ছমাস আগে। এর ভেতর মেসেজ আসা কমতে কমতে কখনো সখনো একটি আসে। তার বেশির ভাগই উত্তর না দেয়ার মতো! একদিন একজন বারবারই মেসেজ পাঠাচ্ছেন ফোন করার অনুমতি চেয়ে। নেবুলা দীর্ঘ নীরবতার পর একসময় অনুমতি দিল। ভদ্রলোক বললেন, আমার নাম হায়দার! সেনাবাহিনীতে ছিলাম। মেজর হিসাবে রিটায়ার করতে যাচ্ছি…।
নেবুলা একটু রেগেই বলল, স্ত্রী’র কি হল তাই আগে বলেন?

: আপনি আমার কথা বাদ দিয়ে আগেই স্ত্রী’র কথা শুনতে চান?

: আসলে এতজনের এতকথা শুনে ফেলেছি, আর শুনতে ইচ্ছে করে না। অযথা কথার খরচ। ঘরের তথ্য বের করে দেয়া…।

: আচ্ছা, শোনেন। আমি মিশনে গিয়েছিলাম, সেখান থেকে এসে দেখি, বউ ঘর খালি করে যা নেয়ার মতো এবং ছেলেমেয়ে দু’টিকে নিয়ে তার পুরনো প্রেমিকের সাথে চলে গেছে…!

: থামুন! থামুন! আচ্ছা, আপনার ওয়াইফ যার সাথে গেছেন, তিনি কি আপনার বস্?

: না! এমন প্রশ্ন করলেন কেন বলেন তো?

: মেজরের বৌ তো সাধারণ মানুষ নেয়ার কথা নয়! আর প্রেমিক যে পুরনো, তা জানলেন কি করে?

: নাহলে এভাবে যায়?

: যায়! কারণ তার ভেতর যে সুকুমারবৃত্তিগুলো আছে, তা সারাজীবনে কাছে থেকেও যারা না দেখে, মূল্যায়ণ না করে, আর তাই যদি কেউ অবেলায়ও এসেও দেখে, তখন অতীতের সবাইকে ছেড়ে ওকেই তার নিজের বলে মনে হয়। মনে হয়, ওর জন্যই তো এতদিন পথ চেয়ে ছিলাম!

: দারুণ বলেন আপনি? তা লেখেন টেকেন নাকি?

: লিখি না। পবে পড়ার অভ্যাস আছে। দূরে বসবাস করা আত্মীয়-পরিজন, চেনা সবাইকে আমার চিঠি লিখে খোঁজ নিতে ভাললাগে!

: বাহ্! যেখানে পোস্ট অফিসগুলো মরতে বসেছে সেখানে আপনি চিঠি লিখে সম্পর্ক বাঁচিয়ে রাখেন!

: তারপর, আপনার স্ত্রী’র সাথে আইনত ছাড়াছাড়ি হয়েছে?

: নাহলে সে বিয়ে করলো কি করে?

: কিন্তু আমি তো কোনো স্ত্রী পরিত্যাক্ত মানুষের সাথে সম্পর্কে জড়াবো না!

: এত বাছলে পাবেন কাউকে?
: হয়ত পাবো না!
: তাহলে বিজ্ঞাপণ দিয়েছিলেন কেন?
: খুঁজলেও যে সবকিছু পাওয়া যায় না, তা অন্তত জানতে!
: একটি কথা বলি, রাখবেন?
: বলেন?
: আপনি আমাকে আধঘন্টা সময় দেন!
: আচ্ছা!

: কাল খুব সকালে আপনার বাসার সামনে থেকে আমি আপনাকে তুলে একসাথে কিছুটা সময় আমরা গাড়িতে ঘুরবো। তাতে আমাদের আরো কিছু কথা হবে, দেখাটাও হয়ে গেল।

: এত তাড়াতাড়ি?

: ঝেড়ে ফেলতে হলেও তাড়াতাড়ির দেখায় ফেলা যায়। দেখেন আমার কথা রেখে!

: কিন্তু আপনি আমার বাসা চেনেন কি করে?
: চিনি, তাই বলছি নাকি? ঠিকানা আপনি দেবেন এখন!
নেবুলা হায়দারের কথায় রাজি হয়ে যায়! সারারাত ঘুম আসে না নেবুলার। যেন সে অভিসারে যাচ্ছে। আরেক মন বলে, অভিসারই তো! ফজরের আজান শুনে সে নামাজ পড়ে নেয়। তবে আলাদাভাবে কোনো প্রার্থনা সে কোনদিনই করে না। মুখে একটু হালকা প্রসাধন মেখে ভোরের উপযোগী একখানা শাড়ি বাছতে বাছতে ফোনটা বেজে উঠল। রাতে হায়দার বলেছিল, আপনার সাথে কথা বলতে বলতে আমার ব্যালেন্স শেষ! একটি কল দেয়ার টাকা আছে। তাই ফোনটা বাজলে ধরবেন না কিন্তু। শুধু নিচে নেমে আসবেন। আমি আপনার বাসার উল্টো দিকের রাস্তায় থাকব!
উত্তরা পাঁচ নাম্বার সেক্টরের সতেরো নাম্বার রোডের বাড়িটি থেকে নেবুলা রাস্তার ওপারে একখানা নীল রঙের গাড়ি দেখে, রাস্তা পার হতে হতে কেউ একজন দরজা খুলে দিলে নেবুলা কোনোদিকে না তাকিয়ে তাতে ঢুকে পড়ল। ভোরের খালি রাস্তা দিয়ে গাড়িখানা ফাঁকা মাঠ আর লেকের পাড় ঘেঁষে ঘেঁষে নেবুলাকে নিয়ে চলল। পাশের মানুষটির একটিও কথা নেই। বাকপ্রিয় নেবুলারও কণ্ঠ বোজা! শুধু পাশাপাশি দুজন মানুষের অস্তিত্বই দুজনের কাছে বিরাজমান। পাশে কে আছে জানে না নেবুলা! একবারও তাকায়নি নেবুলা তার মুখের দিকে। কিন্তু তবু তার মনে হচ্ছিল, অনন্তকাল এভাবেই ছুটতে থাকুক তারা! মাটির স্পর্শ ছেড়ে মেঘ ছুঁয়েও যদি চলতে হয়, তবু নীল এই টয়োটাখানা পঙ্খিরাজ ঘোড়া হয়ে যাক! কিন্তু পাশে যে আছে, সে কি চাইবে শুধু কোনো রাজকন্যার উদ্দেশ্যে কোনো মেঘ ছুঁয়ে চলা পঙ্খিরাজ ঘোড়ায় চড়া রাজার কুমার হতে?
একসময় গাড়িখানা থামল। হায়দার নেমে দরজা খুলে দিয়ে বলল, আমাকে পছন্দ হল?
নেবুলা চমকে উঠে এই প্রথম হায়দারের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, এ কোথায় নিয়ে এলেন?
: আরে আপনার বাড়ির সামনেই! ওই দেখেন, ওই আপনার বাড়ি! কার ফ্ল্যাটের বাগান বিলাস বারান্দা উপচে ঝুলে পড়ছে!
: আসলে এতো সকালে কুয়াশা মোড়ানো অবস্থায় তো বাড়িটি কখনো দেখিনি! আর রাস্তাও এমন জনমানবহীন দেখিনি! মনে হচ্ছে স্বপ্নের কোনো শহরে এসে নামছি। যেখানে মানুষ নয়, এলিয়েনরা থাকে।
: বললেন না তো, আমাকে পছন্দ হল কি না?
: নেবুলা স্মিত হেসে হায়দারের মুখের দিকে তাকিয়ে এমনভাবে উত্তর দিল, এতক্ষণ যে সে হায়দারের মুখের দিকে তাকাতেই পারেনি তা বোঝা গেল না। নেবুলা বলল, এমন পছন্দ তো উত্তম কুমারকেও হয়। তাই বলে তিনি চাইলেও তো আমি তার সাথে ঘর করতে যাব না!
: বড় ডায়নামিক উত্তর!
 : আপনি কিন্তু এককাপ চা খেয়ে যেতে পারেন।
: আমি এমনি যেতে পারি। চা খাব না!
ঘরে এসে সোফায় বসতে বসতে হায়দার বলল, এখানে আর কে কে থাকে?

সর্বশেষ
জনপ্রিয়