ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

‘বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনে টকবকে উঠল শরীরের রক্ত’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৪৬, ৩ ডিসেম্বর ২০২০  

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়েরও ছিল উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। বাদ যায়নি গারো সম্প্রদায়ও। দেশকে শত্রুমুক্ত করতে তারাও বীরের বেশে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। সম্প্রতি নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দার গারো অধ্যুষিত এলাকা ঘুরে এসে মুক্তিযোদ্ধার বীরত্বপূর্ণ স্মৃতিকথা তুলে ধরেছেন লাবণ্য লিপি।

শীতের সকালে তখন মিষ্টি রোদ ছড়িয়ে পড়েছে। একটি নতুন দিনের শুরু নতুন স্বপ্ন নিয়ে। আমরা কেবল চায়ের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছি। তখন তাকে দূর থেকে আসতে দেখলাম। মাথা উঁচু করে হেঁটে এলেন। একাত্তরে শপথ নিয়েছিলেন- বাঁচলে স্বাধীন দেশে মাথা উঁচু করে বাঁচবেন। এ প্রতিজ্ঞাই হয়তো বয়সের ভারেও মাথা নোয়াতে দেয়নি তার। তিনি অখিল চন্দ্র হাজং। একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাঙালি জাতির সবচেয়ে বড় অর্জন মহান মুক্তিযুদ্ধে দেশের আপামর জনসাধারণের সঙ্গে আদিবাসী সম্প্রদায়েরও ছিল উল্লেখযোগ্য অংশগ্রহণ। বাদ যায়নি গারো সম্প্রদায়ও।

মুক্তিযুদ্ধের সময় গারো অধ্যুষিত ময়মনসিংহ ও নেত্রকোনার সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর কয়েকটি ঘাঁটি ছিল। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকসেনারা গারো জনপদে অমানসিক নির্যাতন চালায়; নারীদের সম্ভ্রম লুট করে; বাড়ি-ঘর জ¦ালিয়ে দেয়। সে সময় অনেক গারো পরিবারই জীবন বাঁচাতে সীমান্ত পেরিয়ে ভারতের ত্রিপুরায় আশ্রয় নিয়েছিল। কিন্তু পালিয়ে কতক্ষণ বাঁচা যায়! এ বোধ থেকেই গারো তরুণদের একটা বড় অংশ সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশকে শত্রুর হাত থেকে রক্ষা করতে জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। সেই দিনের সেই তরুণদের একজন অখিল চন্দ্র। তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম কেমন ছিল তার ’৭১-এর দিনগুলো।

একটু ভাবলেন। স্মৃতিগুলো গুছিয়ে একসঙ্গে করে নিলেন হয়তো। তার পর বলতে শুরু করলেন- চারপাশে পাক সেনাদের অত্যাচারে এমনিতেই ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে উঠেছিলাম। কিন্তু বুঝে উঠতে পারছিলাম না, কী করব। ঠিক তখনই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনলাম। তিনি বললেন, ‘যার যা আছে তাই নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে।’ ব্যস! সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলাম। আমি তখন কেবল ইন্টারমিডিয়েট পাস করেছি। শরীরে টগবগে রক্ত। রক্ত নেচে উঠল। মা-বাবার কাছে গেলাম যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি চাইতে। অনুমতি ঠিক নয়, আশীর্বাদ নিতে। কারণ সিদ্ধান্ত আমি আগেই নিয়ে নিয়েছিলাম। মা প্রথমে বললেন, যদি তোমার কিছু হয়ে যায়! কিন্তু সাহস দিলেন বাবা। বললেন, কিচ্ছু হবে না। যাও তুমি। অত্যাচারীদের হাত থেকে দেশকে বাঁচাও। মা-বোনের ইজ্জত বাঁচাও। তখন অনুমতি মিলল মায়েরও। আর আমাকে ঠেকায় কে। চলে গেলাম নাম লেখাতে। আমরা ছিলাম ১১ নম্বর সেক্টরে। বাঘমারাতে ছিল রিক্রুটিং অফিস। ওরা নাম লিখে নিল। একটা রাত ওখানে ছিলাম। অন ডিউটিতেই। পর দিন সকাল সাতটায় আমাদের পঞ্চাশ জনের একটা দলকে ট্রেনিংয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হলো।

তিনি বলে চলেছেন স্মৃতি হাতড়ে, আমরা গাড়িতে করে যাচ্ছি। কোথায় যাচ্ছি তা জানি না। জানতে ইচ্ছেও করছে না। আমি কেবল যুদ্ধ করার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছি। সকাল নয়টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম তুরার ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে নাশতা করার পর আবার আমাদের গাড়িতে তোলা হলো। যাচ্ছি তো যাচ্ছিই। সারাদিন গেল, রাত এল। রাত পেরিয়ে ফের ভোরের আলো ফুটল। আমরা থামলাম। বাইরে তাকিয়ে দেখি বানরের দল লাফালাফি করছে। এটা কোন জায়গা? এক সৈনিক বললেন, ভুটানের বগাটোলিয়া ক্যান্টনমেন্ট। আমরা জঙ্গল পরিষ্কার করে তাঁবু টানিয়ে নিলাম। লুঙ্গি, গেঞ্জি, গামছা আর খাবারের জন্য থালা দেওয়া হলো আমাদের। এলাকাটা ছিল পাহাড়ি। কালো পাথরের পাহাড় থেকে ঝরনার জল গড়িয়ে পড়ছে। দূরে বালুময় মরুভূমি আর কাশবন পেরিয়ে কী যেন একটা দেখা যায়। ওটা কি? জানা গেল, কামরুপ কামাক্ষা।

‘আমাদের ট্রেনিং শুরু হলো। একুশ দিন ধরে চলল ট্রেনিং। আমাদের ইন্সট্রাকটর ছিলেন সুলতান স্যার ও ব্রিগেডিয়ার রণজিৎ সিং। ওনারা আমাদের বললেন, একজন সৈনিককে কঠিনতর প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যেতে হয়। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের হাতে সে সুযোগ নেই। অল্প সময়ে নিজেকে বাঁচিয়ে শত্রুকে ঘায়েল করাই আমাদের উদ্দেশ্য। তোমরা আপাতত সেটুকুই রপ্ত করবে। একটা কথা মনে রেখো, তোমার নিজের জীবন মূল্যবান। নিজে না বাঁচলে দেশকে বাঁচাবে কেমন করে? আর বেঁচে থেকে স্বাধীনতার স্বাদ নেওয়া এক অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। পাহাড়ের ওপর গর্ত করে আমাদের ট্রেনিং দেওয়া হয়- কীভাবে হ্যান্ড গ্রেনেড চালাতে হয়; চালাতে হয় অন্যান্য সব অস্ত্রশস্ত্র। আমাদের দিয়ে দেওয়া হলো স্টেনগান, রাইফেল, জিএফ রাইফেল, এলএমবি, হ্যান্ড গ্রেনেড।

ট্রেনিং শেষ করে আমরা রংরায় এলাম। আমাদের দলের প্রধান ছিলেন ক্যাপ্টেন চৌহান। সেই রাতেই অস্ত্র হাতে দিয়ে আমাদের নামিয়ে দেওয়া হলো নিজ নিজ এলাকায়। আমরা নামলাম চুতানগরে। সেই রাতেই রেকি করে খবর পাওয়া গেল, শেষ রাতে পাকবাহিনী নাজিরপুরের দিকে অগ্রসর হবে। আমরা পজিশন নিয়ে নিলাম। ওদের অস্তিত্ব টের পেয়ে শুরু করলাম গোলাগুলি। ওরাও পাল্টা গুলি ছুড়ছে। হঠাৎ ‘আ- আ’ শব্দে কেঁপে উঠল রাতের অন্ধকার। বুঝলাম, নিশানা ঠিক জায়গায় লেগেছে। আমাদের দলের কমান্ডার ছিলেন এনায়েত বিশ^াস। লড়াইয়ের অংশ হিসেবেই একসময় আমরা পিছু হটতে লাগলাম। কারণ অন্ধকারে ছুটে আসছে গুলি। পাশেই একটা ছোট পুুকুর ছিল। সেই পুকুরে ঝাঁপিয়ে পড়ে আমরা কয়েকজন জীবন রক্ষা করি। ওটাই ছিল আমাদের প্রথম অ্যাকশন। পরদিন রেকি করার পর জানলাম, ওই জায়গায় অনেক রক্ত ছড়িয়ে আছে।

সাত দিন পর খবর এলো পাকসেনারা কলমাকান্দা অ্যাটাক করবে। আমরা কলমাকান্দা রওনা করলাম। সেখানে আমরা পরপর কয়েকটা অভিযানে অংশ নিলাম। এক রাতের কথা। যুদ্ধ চলছে। আমি ছিলাম স্পট থেকে দুশ গজ দূরে। বাঁশঝাড়ের ভেতর। দূর থেকে শাঁই শাঁই করে ছুটে আসছে রকেটবোম। তারই একটা এসে লাগল আমাদের দলের সুরেশ খুরের পায়ে। ওর পা গেল ভেঙে। ক্যাপ্টেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে পরে তাকে চিকিৎসার জন্য মাদ্রাজে পাঠানো হয়। কমলাকান্দা তখন আমাদের দখলে। ভারতীয় সৈনিকরা ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। খবর এলো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। বিজয়ের ঘোষণা এলো। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সে কী আনন্দ।

আমরা বিরিশিরি থেকে পূর্বধলা এবং পরে সেখান থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত গেলাম। যাওয়ার পথে সারা রাস্তায় পড়ে থাকতে দেখলাম শুধু লাশ আর লাশ। একটার ওপরে একটা। সেগুলো শনাক্ত করার কোনো উপায় নেই। ময়মনসিংহ সিটি কলেজে গিয়ে দেখা হলো আমাদের যিনি ট্রেনিং দিয়েছিলেন সেই সুলতান স্যারের সঙ্গে। এটা যে কত বড় সৌভাগ্য। তাকে দেখে আমরা ভীষণ খুশি হয়ে উঠলাম। তার পা ছুঁয়ে সালাম করলাম। উনি আমার কপালে চুমু খেয়ে বললেন, তোমরা এখন স্বাধীন। তোমাদের আর মৃত্যুর ভয় নেই। যাও তোমরা বাঁচো! সেদিনের সেই আনন্দ ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না।

সাত দিন পর বাড়ি ফিরে এসেছিলাম। আমি আমার কথা রেখেছিলাম। মা-বাবাকে বলেছিলাম, দেখ, আমরা দেশ স্বাধীন করেছি! এটা আমাদের দেশ, স্বাধীন দেশ।- স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতিময় গল্পের ইতি টানলেন অখিল চন্দ্র হাজং।

আরও পড়ুন
সারাদেশ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়