ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ৫ ১৪৩০

বঙ্গবন্ধুর সাথে ছোট বেলার স্মরণীয় মধুর স্মৃতি

সম্পাদকীয় ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৭:১৭, ২০ আগস্ট ২০২০   আপডেট: ০৭:২৪, ২০ আগস্ট ২০২০

আলহাজ্জ এ কে এম রফিকুল আলম, বীর মুক্তিযোদ্ধা

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সুযোগ্য নেতৃত্বে একটি দেশ ও একটি জাতি গঠিত হয়েছে। তিনি হলেন হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি। সমস্ত বাঙালি জাতি তাকে নিয়ে গর্ববোধ করে। তিনি বিশ্বনেতা। আমাদের গোপালগঞ্জে এই ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ জন্মগ্রহণ করায় আমরা গোপালগঞ্জবাসী ধন্য ও গর্বিত।
আমার ছোট বেলার একটি স্মরণীয় ঘটনা এখানে বর্ণনা করছি। আমার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেলার সদর উপজেলার কাঠি ইউনিয়নের সুলতানপুর মানিকহার গ্রামে। বাবা ডাক্তার ও চাচা ব্রিটিশ আমল থেকে ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকায় আমরা এলাকায় খুব সুখ্যাতি ও শান্তির সাথে বসবাস করছিলাম। বর্ষাকালে আমাদের গ্রাম পানিতে ডুবে যায় বলে বাড়িগুলো উঁচু টিলার মত।

১৯৫৩ সালের শেষ অথবা ১৯৫৪ সালের প্রথম দিকের ঘটনা, যখন আমি ৪র্থ/৫ম শ্রেণির ছাত্র। তখন আমি হাফ প্যান্ট পরতাম। আমার খেলার ছোট বলটি বাড়ির নিচে গড়িয়ে পড়লে আমি বল খোঁজ করছিলাম। এমন সময় পিছন থেকে কেউ একজন পিঠে হাত রেখে স্নেহমাখা কণ্ঠে বলেন, “ভাইটি কেমন আছ?” আমি পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখি লম্বা, শ্যামলা, ছিপছিপে গড়নের এক যুবক। তার সঙ্গে থাকা আরেক ভদ্রলোক আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, “প্রেসিডেন্ট সাহেব কি বাড়ি আছেন?”

আমি তাদেরকে সালাম জানিয়ে বললাম যে, তিনি বাড়ি আছেন এবং তাদেরকে আমাদের বৈঠকখানায় বসতে দিয়ে চাচাকে ডেকে আনলাম। আমিও পাশে দাঁড়িয়ে তাদের কথাবার্তা শুনতে থাকলাম। আমি লক্ষ করলাম যে, লম্বা ও ছিপছিপে গড়নের লোকটি যুক্তিপূর্ণ বলিষ্ঠ কণ্ঠে চাচার সাথে কথা বলছিলেন। সেই দিন থেকে আমি জানতে পারি বলিষ্ঠ কণ্ঠটি শেখ মুজিবুর রহমানের এবং তিনি বাঙালি জাতির অধিকার আদায়ের কালজয়ী নেতা।

সেই সময় থেকে তাঁর স্নেহমাখা ব্যবহার এবং যুক্তিপূর্ণ কথা শুনে আমি তাঁর ভক্ত হয়ে যাই এবং সুযোগ পেলেই তাঁর বক্তৃতা/বিবৃতি পরম আগ্রহে শুনতে থাকি। উল্লেখ্য যে, আমার চাচা ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্ট থাকায় ওয়াহিদুজ্জামান (পাকিস্তানের প্রাক্তন কমার্স মিনিস্টার), প্রাক্তন এমপি ফায়েকুজ্জামান, অ্যাডভোকেট আ. ছালাম খান প্রমুখ প্রায়ই বিশেষ করে নির্বাচনের আগে আমাদের বাড়িতে আসতেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর মত যুক্তিপূর্ণ, বলিষ্ঠ কণ্ঠ ও জাতীয়বাদ দিয়ে কেউই আমাকে মুগ্ধ করতে পারেনি।
মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান হওয়ায় এবং প্রতি বছরের বন্যায় ফসল ধ্বংস হওয়ায় আমাদের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই ১৯৬৩ সালে বিএসসি পাস করার পর তিন বছর সহকারী হেড মাস্টার কাম বিজ্ঞান শিক্ষক হিসেবে কোটালীপাড়া ইউনিয়ন ইনস্টিটিউশন (বালিয়াডাঙ্গা) ও মেরী গোপীনাথপুর হাই স্কুলে শিক্ষকতা করি। পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডির অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির এক্সপ্লোসিভস ফ্যাক্টরিতে প্রডাকশন কেমিস্ট হিসেবে কাজ করায় তখন আমার পক্ষে সক্রিয় রাজনীতি করা সম্ভব ছিল না।

১৯৭০ সালের শেষ ভাগে বাংলাদেশ অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে বদলি হয়ে আসি। এসেই জানতে পারি গাজীপুর ইউনিয়নে জনাব আ ক ম মোজম্মেল হক (বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী) ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদের জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আমি তাঁর সঙ্গে দেখা করি এবং সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীগণকে মোজাম্মেল সাহেবকে ভোট দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানাই। জনাব মোজাম্মেল বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

পরবর্তী পর্যায়ে পাকিস্তানের জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকরা বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা হস্তান্তরে তালবাহানা শুরু করে। শুরু হয় আন্দোলন, যা পরবর্তীতে পাকিস্তানিদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুর আচরণের জন্য স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপ নেয়। আমরা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে মিটিং-মিছিল করতাম। সেসব মিটিংয়ে আমাদের শ্রমিক নেতারা বিশেষ করে আঃ ছালাম, সেকেন্দার আলী, নজরুল ইসলাম, আ. সাত্তার প্রমুখ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিতেন।

অপর দিকে মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির জনাব মোতালেবের (পরবর্তীতে সিলেটের এমপি ছিলেন) নেতৃত্বে মিটিং মিছিল ও আন্দোলনও চলতে থাকে। সেই সময়ে গাজীপুরের স্থানীয় লোকজন শিক্ষা-দীক্ষা ও আর্থিক দিক দিয়ে খুবই অনুন্নত ছিল। তবে তারা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ও মেশিন টুলস্ ফ্যাক্টরির আন্দোলনে সহযোগিতা করতো। আন্দোলনের দিক থেকে অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি ছিল এক নম্বরে। তারাই পাকিস্তানি অফিসার মারার সাথে জড়িত ছিল এবং অস্ত্রভাণ্ডার খুলে দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে অস্ত্র তুলে দিয়েছিল।

মেশিন টুলস ফ্যাক্টরির কর্মচারীগণ দ্বিতীয় স্থানে থেকে সর্বদা অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির নেতাদের সহযোগিতা করতেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকায় এবং স্বাধীনতার পরে কারখানাগুলি বন্ধ থাকায় কারখানার সকল কর্মকর্তা/কর্মচারীগণ দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। তাই রাজনীতি স্থানীয় লোকের হাতে চলে যায়। ফলে স্থানীয় জনগণ আন্দোলনের কৃতিত্ব পেয়ে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে, যুদ্ধ শুরু হওয়ার পরপরই অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আমি গাজীপুর থেকে গোপালগঞ্জে চলে আসি ও মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি।

গত জাতীয় নির্বাচনের পরে ২০১৯ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পরে একজন গর্বিত মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমতিক্রমে তাঁকে শুভেচ্ছা জানাতে গণভবনে যাই। বঙ্গবন্ধু কন্যা, দেশনেত্রী, বিশ্বনেত্রী মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে দেখা করে বুঝতে পারি তিনি কত বড় মন ও বড় মাপের মানুষ। তাঁর সাবলীল কথাবার্তা ও আন্তরিকতা আমাকে ভীষণভাবে মুগ্ধ করে। তাঁর ভাল ব্যবহার ও কথাবার্তায় মনে হয়েছিল তিনি কত আপন, আন্তরিক ও পূর্ব পরিচিত। অথচ এটা ছিল মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে আমার জীবনের প্রথম সাক্ষাৎ। তার ব্যবহার ও কথাবার্তায় ছোটবেলার বঙ্গবন্ধুর সেই স্নেহমাখা অম্লান কথাটি “ভাইটি কেমন আছ?” মনে পড়ে যায়।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়