ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৪ ১৪৩১

বাংলায় ক্রিকেট এনেছিলেন যিনি: সারদারঞ্জন

স্পোর্টস ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:১৭, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

ব্যাট হাতে সারদারঞ্জন

ব্যাট হাতে সারদারঞ্জন

আজ যে জায়গায় বাংলাদেশের ক্রিকেট দাঁড়িয়ে, তা একদিনের নয়। বহু বছরের, বহু ইতিহাসের চড়াই-উতড়াই পেরিয়ে বর্তমান বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল। বাঙালির ক্রিকেট ইতিহাসের শুরুর সেই গল্প বলতে গেলে ফিরে যেতে হবে আঠারো শতকে ময়মনসিংহ অঞ্চলে। সেখানে তখন বিদ্যুৎ ছিল না, কংক্রিটের ভালো রাস্তা-ঘাট ছিল না, শিক্ষা-দীক্ষা-অর্থ ছিল অপ্রতুল; ছিল জমিদারি শাসন ব্যবস্থা- এ হলো সেই সময়ের কথা। তবে পালাগান ছিল জমজমাট।

‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র জন্য বিখ্যাত এ জনপদ। এই পালাগানের সংগ্রাহক চন্দ্রকুমার দে। পরে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তা প্রকাশ করেন। ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে এই অঞ্চলেই প্রথম ক্রিকেটের হাতেখড়ি হয়। হাতেখড়ি হয়েছিল যার মাধ্যমে তিনি সারদারঞ্জন রায়। ষোড়শ শতকে ক্রিকেট খেলার প্রচলন হয় বলে ধারণা করা হয়। ইংল্যান্ড দাবি করে- তারা এই খেলা প্রচলন করেছে। কিন্তু অনেক ক্রিকেট বোদ্ধা মনে করেন, এর প্রচলন ৭ম শতাব্দীতেও ছিল। তখন ব্যাট-বল নামে একটি খেলা ভারতীয় উপমহাদেশে চর্চা হতো। পাঞ্জাব প্রদেশের ‘দোয়াব’ এলাকার অধিবাসীরা সর্বপ্রথম ক্রিকেটের মতো ব্যাট-বল নামক একটি খেলার গোড়াপত্তন করে। যাই হোক, আন্তর্জাতিকভাবে ক্রিকেট খেলা শুরু হয় ১৮৭৭ সালের ১৫ মার্চ।

অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন। ওই সময় দুই বনেদি ক্রিকেট দল অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের মধ্যে প্রথম টেস্ট ম্যাচ হয়। এই ম্যাচকেই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্রিকেটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা বলে ধরা হয়। কিন্তু তার আগে, ১৮৭০ সালেই বাংলায় সারদারঞ্জন রায় ক্রিকেট ইতিহাসের সূচনা করেছিলেন। বাঙালিদের খেলাটির সঙ্গে পরিচিত করিয়ে দেন তিনি। বিশেষ করে সাধারণ বাঙালিদের সঙ্গে। সে-হিসাবে বাঙালির ক্রিকেটের ইতিহাস দেড়শ বছরের অধিক।

সারদারঞ্জন ১৮৬১ সালে বাংলাদেশের কিশোরগঞ্জ জেলায় মসুয়া গ্রামের রায় পরিবারে জন্মেছিলেন। কালীনাথ রায় ছিলেন তাঁর বাবা। শিক্ষা জীবনের শুরুটা এখান থেকেই। কিশোরগঞ্জের মাইনর স্কুলে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করে ভর্তি হন ময়মনসিংহ জেলা স্কুলে। তিনি মেধাবী ছিলেন, পেয়েছিলেন প্রেমচাঁদ রায় বৃত্তি। পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে সারদারঞ্জন রায় সবার বড়। অন্যরা হলেন কামদারঞ্জন, মুক্তিদারঞ্জন, কুলদারঞ্জন, প্রমোদারঞ্জন, গিরিবালা, ষোড়শীবালা ও মৃণালিনী।

এক পর্যায়ে ভাই কামদারঞ্জন পরিচিত হয়ে ওঠেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী নামে। কিন্তু কেন? পৃথিবীর বিচার কখনো কখনো সমান হয় না। যে পায়, সে অনেক পায়। যে পায় না, সে কিছুই পায় না। কালীনাথ রায়ের ভাই জমিদার হরিকিশোর রায়চৌধুরী এবং তাঁর স্ত্রী রাজলক্ষ্মী দেবী ছিলেন নিঃসন্তান। তাই কামদারঞ্জনকে পাঁচ বছর বয়সে দত্তক নিয়েছিলেন তাঁরা। নাম পরিবর্তন করে রেখেছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী। যিনি ছিলেন বাংলা সাহিত্যের অবিস্মরণীয় শিশুসাহিত্যিক, চিত্রকর এবং বাংলা ছাপাখানার পথিকৃৎ। তাঁর ছেলে সুকুমার রায়ও বিখ্যাত ছড়াকার। সুকুমার রায়ের ছেলে সত্যজিৎ রায়কে নিশ্চয়ই পাঠককে আলাদা করে পরিচয় করিয়ে দিতে। ‘পথের পাঁচালী’র জন্য অস্কার জিতেছিলেন তিনি।

এই সত্যজিৎ রায়ের পিতামহ সারদারঞ্জন রায় পাঠ্য-বইয়ের সঙ্গে আরো একটি জ্ঞান সর্বদা লালন করতেন, আর তা হলো  ক্রিকেট। তিনি পড়েছেন ঢাকা কলেজে। বিএ পরীক্ষায় ঢাকা অঞ্চলের মধ্যে হন প্রথম। কিন্তু ক্রিকেটের প্রতি তাঁর যে ঝোঁক তা থেকে দূরে থাকতে পারেননি। তাঁর নেতৃত্বেই এ অঞ্চলে ক্রিকেট খেলার বিস্তার ঘটতে থাকে। তাঁর হাতেই বাংলার প্রথম ক্রিকেট ক্লাব ঢাকা কলেজ ক্লাব প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮০ সালে। এই ক্লাবের মাধ্যমেই চলতে থাকে ক্রিকেট চর্চা। মাঝে তিনি সংস্কৃত পড়তে যান কলকাতা। তবে শেষ করেন নি। অসমাপ্ত রেখে গণিত শিক্ষক হিসেবে অধ্যাপনায় নিযুক্ত হন। কিন্তু ক্রিকেট?

ক্রিকেট তিনি ছাড়তে পারেন নি, ক্রিকেটও তাকে ছাড়ে নি, তাঁর সঙ্গেই আছে। ১৮৮৪ সালে কলকাতার ইডেন গার্ডেনে ক্যালকাটা প্রেসিডেন্সি ক্লাবের সঙ্গে এক খেলায় ঢাকা কলেজ জয়লাভ করে। এ জয়ের ধারায় ছন্দপতন খুব একটা হয় নি। ঐ বছরই কলকাতার ঐতিহ্যবাহী টাউন ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন সারদারঞ্জন। এটি ছিল ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধ এবং স্বদেশী জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বেলিত করার একটি কৌশল। কেননা সে-সময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে নিয়মিত খেলত ঢাকা কলেজ ক্রিকেট ক্লাব এবং কলকাতার টাউন ক্লাব। ব্রিটিশরা শাসক আর তারা শোষিত।

এরই ধারাবাহিকতায় ‘নন্দন-কানন’খ্যাত ইডেন গার্ডেনের মাঠে হঠাৎই একদিন টাউন ক্লাবের হয়ে খেলতে দেখা যায় স্বামী বিবেকানন্দকে। সবাই অবাক! অবাক হলেও সত্য, সেই ম্যাচে স্বামী বিবেকানন্দ আরো খানিকটা অবাক করে দিয়ে তুলে নেন ৭ উইকেট! সেদিন ব্রিটিশদের গঠন করা কলকাতা ক্রিকেট ক্লাবের মুখোমুখি হয়েছিল টাউন ক্লাব। উল্লেখ্য যে, কলকাতা ক্রিকেট ক্লাব ১৭৯২ এবং কলকাতা টাউন ক্লাব ১৮৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী নেতা হেমচন্দ্র ঘোষের কাছে সারদারঞ্জনের সন্ধান পান স্বামী বিবেকানন্দ। তাদের দুজনের অনুপ্রেরণায় স্বামী বিবেকানন্দের পা পড়ে ক্রিকেট মাঠে। ১৮৮৭ সালে তিনি অবশ্য সন্ন্যাস জীবন গ্রহণ করেন। তার আগে বছর দুই পর্যন্ত টাউন ক্লাবের সঙ্গে জড়িত ছিলেন তিনি। যদিও ক্রিকেট তখন গণমানুষের, সাধারণ মানুষের খেলা ছিল না।

ভারতের দিল্লি ও বোম্বে ক্রিকেট চর্চা হতো তুলনামূলক বেশি। কেননা তৎকালে ক্রিকেট খেলা ছিল ব্যয়বহুল। ব্যাট-বল আসত বিলেত থেকে। সুতরাং দাম যে আকাশ ছোঁয়া হবে- এ তো অনুমান করাই যায়। ক্রিকেট খেলার সরঞ্জাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে ছিল, তাই একে ‘সাহেবী খেলা’ও বলা হতো। এসবের কারণে ক্রিকেট সীমাবদ্ধ ছিল কেবলমাত্র অভিজাত শ্রেণীর মধ্যে। এমতাবস্থায় সারদারঞ্জন ক্রিকেট খেলার সামগ্রী উৎপাদন করবেন বলে পরিকল্পনা করেন। কলকাতার যশোর রোডে ১৮৯৫ সালে তিনি ‘এস রায় অ্যান্ড কোম্পানি’ নামে ক্রিকেট সামগ্রীর একটি কারখানা প্রতিষ্ঠা করেন। যেখানে ব্যাটও বানানো হয়। এ প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলার প্রথম ক্রিকেট সামগ্রী সুলভমূল্যে বিক্রয় করা হয়। জানা যায়, ১৯০৬ সালে সারদারঞ্জনের কারখানায় তৈরি হওয়া ‘ব্যালান্সড ব্যাট’ বিশেষ পুরস্কার পেয়েছিল।

পূর্ব বাংলায় জন্ম তাঁর; তাই এখানকার খেলোয়াড়দের প্রতি আলাদা স্বপ্ন ছিল সারদারঞ্জন রায়ের। যে কারণে তিনি ১৯২০ সালে ইস্ট বেঙ্গল ক্লাব প্রতিষ্ঠা করেন। ক্লাবের প্রথম প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্টও ছিলেন তিনি। ছিলেন ক্রিকেটের দক্ষ সংগঠক। ক্রিকেট কোচ হিসেবেও সারদারঞ্জন রায়ের অবদান অসামান্য। কিন্তু এ যুগে এসে আমরা ক’জন চিনি তাঁকে? 

সর্বশেষ
জনপ্রিয়