ঢাকা, শনিবার   ২০ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৭ ১৪৩১

বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছিল গ্রেনেড হামলা!

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:০৬, ২০ জানুয়ারি ২০২৩  

বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছিল গ্রেনেড হামলা!

বিএনপির শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় হয়েছিল গ্রেনেড হামলা!

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা ছিল পাকিস্তানীপন্থী বিএনপি-জামায়াতের বাংলাদেশের মাটিতে সবচেয়ে ন্যক্কারজনক সন্ত্রাসী হামলার একটি। এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ও নৃশংস হামলা। কারণ, হত্যাকারীরা ছিল রাষ্ট্রীয় মদদপুষ্ট এবং রাজনৈতিক বিরোধীদের নির্মূল করার জন্যই এটি চালানো হয়। সেদিন পাকিস্তানপন্থীদের গ্রেনেড হামলায় আহতদের মধ্যে অনেকেরই জীবন এখনও দুর্বিষহ। তখনকার বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলীয় নেতাদের মানব ঢালের ফলে আক্রমণ থেকে রক্ষা পেলেও কানে আঘাত পান, যার প্রভাবে আজ পর্যন্ত তিনি ভুগছেন। আসলে শেখ হাসিনাকে হত্যা করে দলের শীর্ষ নেতৃত্বকে নির্মূল করাই ছিল আক্রমণের মূল লক্ষ্য।

হামলাটি চালায় হরকাতুল জিহাদ (হুজি) নামের একটি জঙ্গী সংগঠন। তার সঙ্গে বিএনপির তৎকালীন যুগ্ম মহাসচিব তারেক রহমান, সরকারের তৎকালীন মন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, বিএনপির উপ-শিক্ষামন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, জামায়াতে ইসলামের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদ, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই এবং এনএসআইয়ের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা ও আইন প্রয়োগকারীরাও সন্ত্রাসী হামলার সঙ্গে জড়িত ছিল।

এছাড়াও কাশ্মীরভিত্তিক বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন হিজবুল মুজাহিদীন, তেহরিক জিহাদ-ই ইসলাম, লস্কর-ই-তৈয়বা এবং মিয়ানমারভিত্তিক রোহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)সহ বেশ কয়েকটি বিদেশী গোষ্ঠীর সঙ্গেও সম্পৃক্ততা প্রমাণিত। ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে দুটি জঙ্গীগোষ্ঠীর উত্থান হয়।

একটি হচ্ছে- কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক হরকাতুল জিহাদ (হুজি), যার নেতৃত্বে ছিল আফগান ফেরত কয়েক যোদ্ধা। অপরটি মধ্যপ্রাচ্যপন্থী জেএমবি।উভয় দলের সঙ্গে জামায়াত-শিবিরের মতাদর্শিক দ্বন্দ্ব থাকলেও পাকিস্তানী গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের কারণে প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে জামায়াত। শিবিরের সাবেক ক্যাডাররা যুক্ত হয়েছিল এসব দলে।

চার্জশীট, বাদীদের সাক্ষ্য প্রমাণ, হরকাতুল জিহাদের প্রধান মুফতি হান্নান এবং খালেদা জিয়ার ভাগ্নে ও তৎকালীন এপিএস-১ সাইফুল ইসলাম ডিউকের স্বীকারোক্তি অনুযায়ী এটি পরিষ্কার যে, এই আক্রমণের উদ্দেশ্য ছিল শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে নিশ্চিহ্ন করা। এই কাজের জন্য হুজি সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। অবশ্য হুজিদের বিকৃত মতাদর্শের কারণে তাদের খুব বেশি অনুরোধ করতে হয়নি। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ নেতৃত্বের জন্য শেখ হাসিনাকে তারা ‘ইসলামের শত্রু’ বলে বিবেচনা করত।

হামলার কয়েকদিন আগেই গুলশানে ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিত তারেক রহমানের রাজনৈতিক কার্যালয়ে হামলার চূড়ান্ত পরিকল্পনা তৈরি করা হয়েছিল। অবশ্য ২০০৪ সালের ফেব্রুয়ারি ও জুন মাসে সিঙ্গাপুরে দাউদ ইব্রাহিম এবং আইএসআইয়ের সঙ্গে তারেক রহমানের অনুষ্ঠিত বৈঠকে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার পরিকল্পনা হয় বলে বিভিন্ন লেখকের উপস্থাপিত তথ্য থেকে জানা যায়। ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী ও জঙ্গীগোষ্ঠীকে সহায়তা অব্যাহত রাখার ক্ষেত্রে শেখ হাসিনাকে মূল বাধা হিসেবে উল্লেখ করে তারেক রহমান। এর পরিপ্রেক্ষিতেই ২১ আগস্ট হামলার পরিকল্পনা করা হয়।

জিয়া পরিবারের পাচারকৃত অর্থ বিনিয়োগের জন্য বিদেশে তৈরি দুটি কনসোর্টিয়ামের মাধ্যমেই ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার অর্থ লেনদেন হয়। আর ‘আর্জেস’ গ্রেনেডও সংগৃহীত হয় এই অর্থের মাধ্যমে। আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড অস্ট্রিয়ায় এবং অস্ট্রিয়ার লাইসেন্সের ভিত্তিতে তৈরি হয় পাকিস্তানে। উপমহাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ছাড়া কেউ এ গ্রেনেড ব্যবহার করে না। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে ব্যবহৃত গ্রেনেড হচ্ছে আর্জেস-৭২। ওই আর্জেস-৮৪ গ্রেনেড ভারতে লস্করে তৈয়বা কর্তৃক ১৯৯৩ সালে মুম্বাই হামলায় ব্যবহার করা হয়েছিল। একই গ্রেনেড ব্যবহার করা হয় সিলেট হামলায় এবং শাহ এএমএস কিবরিয়া হত্যাকা-ে।

হামলার একদিন আগে ২০ আগস্ট হুজি জঙ্গী কাজল ও আবু জান্দাল বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে হামলার স্থান পরিদর্শন করে। অপারেশনটির নাম ছিল ‘লাইট স্ন্যাক্স ফর শেখ হাসিনা’ (শেখ হাসিনাকে নাশতা করানো)। ২১ আগস্ট তারা বাড্ডায় একটি পূর্ব নির্ধারিত বাড়িতে সাক্ষাত করে। সেখানে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, হামলাকারী কাজল ও আবু জান্দালের নেতৃত্বাধীন মোট ১২ জন ওই ঘটনায় অংশ নেবে।

তারপর তারা একসঙ্গে নামাজ পড়বে এবং মধ্যাহ্ন ভোজ করবে। চূড়ান্ত বৈঠকের পর মাওলানা সাঈদ ‘জিহাদ’ সম্পর্কে বক্তৃতা দেয়। এরপর মুফতি হান্নান ১২ জন হামলাকারীর কাছে ১৫টি গ্রেনেড হস্তান্তর করে। আলোচনা অনুযায়ী আছরের নামাজের পর তারা সবাই গোলাপ শাহ মাজারের কাছে উপস্থিত হয়। এরপর তারা ট্রাকের চারপাশে অবস্থান নেয়, যেখানে আওয়ামী লীগ নেতারা সমাবেশে বক্তব্য রাখছিলেন। শেখ হাসিনার বক্তব্য শুরু হলে আবু জান্দাল প্রথম গ্রেনেডটি নিক্ষেপ করে। তারপর প্রত্যেকে নিজের গ্রেনেড নিক্ষেপ করে স্থান ত্যাগ করে।

আগে থেকেই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের কাছ থেকে সহায়তা পাওয়ায় হামলাকারীরা দিবালোকে অপরাধ করেও পালিয়ে যেতে পারে। তবে ১৫ বছর পরে হলেও এই অপরাধীদের বিচারের রায় ঘোষিত হয়েছে। ২০০৮ সালের ১১ জুন সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, হরকাতুল জিহাদের শীর্ষ নেতা মুফতি হান্নানসহ ২২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে প্রথম চার্জশীট দাখিল করে সিআইডি। এরপর বিচারে ২০০৮ সালের ২৯ অক্টোবর থেকে ২০০৯ সালের ৯ জুন পর্যন্ত ৬১ জনের সাক্ষ্য গ্রহণ করেন দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল।

২০০৯ সালের ৩ আগস্ট রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনে অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেয় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল। ২০১১ সালের ৩ জুলাই অধিকতর তদন্ত শেষে তারেক রহমানসহ আরও ৩০ জনের বিরুদ্ধে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করে সিআইডি। ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর এই মামলায় ১৯ জনের মৃত্যুদ- এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদ-ের আদেশ আসে।

২০০৪ সালের ২১ আগস্টের ঘটনার পর সে সময় খালেদা-নিজামী জোট সরকারের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বাবরের তত্ত্বাবধানে একটি তদন্ত কমিটি করে ‘জজ মিয়া’ নাটক সাজানো হয়েছিল। নষ্ট করা হয়েছিল গ্রেনেড হামলার সকল আলামত। ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে জজ মিয়ার কোন দোষ খুঁজে পায়নি। বরং ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৫২ জনকে আসামি করে সম্পূরক চার্জশীট দাখিল করা হলে প্রকৃত অপরাধীদের মুখোশ উন্মোচ হয়।

২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ঘটনায় মনে রাখতে হবে বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে রাষ্ট্রযন্ত্রকে পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়েছিল আইএসআইয়ের সক্রিয় সহযোগী হিসেবে। দল, প্রশাসন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কতিপয় সদস্য এ সহযোগিতা অব্যাহত রাখতে ভূমিকা পালন করে।

পাকিস্তানপন্থী বিএনপি-জামায়াত ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা চালিয়ে বঙ্গবন্ধুর উত্তরসূরি শেখ হাসিনা তথা এদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনার নেতৃত্বকে নিঃশেষ করতে চেয়েছিল। তাদের সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার ৫২ আসামির মধ্যে ৩৩ জন কারাগারে, পলাতক ১২ জনের মধ্যে তারেক রহমান লন্ডনে, কেউ কেউ আছে কানাডা, ব্যাংকক, আমেরিকায়।

হুজির শীর্ষ নেতারা পালিয়েছে পাকিস্তানে। এদের সকলকে অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে এনে বিচারের রায় কার্যকর করা হলে দেশে আইনের শাসন আরও মজবুত হবে। মনে রাখতে হবে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা বিএনপি-জামায়াতের কুকর্মের দলিল।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়