ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

যে ৭ ধরনের ব্যক্তি আশ্রয় পাবেন আরশের ছায়ায়

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৫:২৬, ১২ নভেম্বর ২০২১  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

দুনিয়া হচ্ছে পরকালের শস্যক্ষেত্র। সবাইকে পরকালে দুনিয়ার সব কৃতকর্মের হিসাব দিতে হবে। দুনিয়াতে যেমন কোনো বিচার কাজের জন্য একটা পরিবেশ তৈরি করা হয়; সেটা কেয়ামতেও হবে, যা অত্যন্ত ভয়াবহ। তখন মানুষ খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করবে, সূর্য তার তীব্রতা বাড়িয়ে মাত্র আধ হাত মাথার ওপর অবস্থান করবে। মানুষ তার পাপ অনুযায়ী নিজের ঘামে ডুবে থাকবে। কেউ মাথা, কেউ কাঁধ, কেউ কোমর আর কেউ পা পর্যন্ত ডুবে থাকবে।

কেয়ামতের ময়দানের সেই কঠিন মুহূর্তের বর্ণনা দিতে গিয়ে হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেন, কেয়ামতের দিন মানবমণ্ডলীকে লাল শ্বেত মিশ্রিত এমন এক সমতল ভূমিতে একত্র করা হবে, যেন তা পরিচ্ছন্ন আটার রুটির মতো। ওই জমিনে কারো (বাড়িঘরের বা অন্য কিছুর) চিহ্ন থাকবে না। (বুখারি ও মুসলিম)

কেয়ামতের দিনটি প্রচণ্ড উত্তপ্ত থাকবে। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, বিচারের দিন সূর্যকে মানুষের কাছে আনা হবে, তা হবে তাদের থেকে এক ফরসাখ (তিন মাইল) দূরে। ব্যক্তির আমল অনুযায়ী ঘামের মধ্যে অবস্থান করবে। কারো ঘাম হবে টাখনুসমান, কারো হাঁটুসমান, কারো কোমরসমান, কারো মুখসমান। (মিশকাত, পৃষ্ঠা : ৪৮৩)

সেই বিভীষিকাময় মুহূর্তে মহান আল্লাহ কিছু মানুষকে তার রহমতের ছায়াতলে আশ্রয় দেবেন। রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যেদিন আল্লাহর (রহমতের) ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না, সেদিন সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তাআলা তার নিজের (আরশের) ছায়ায় আশ্রয় দেবেন। (বুখারি হাদিস : ৬৬০)

বুখারি শরিফের এক হাদিসে হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, সাত প্রকার মানুষকে আল্লাহ তায়ালা কেয়ামতের দিন তার আরশের ছায়ায় স্থান দেবেন। সেদিন আরশের ছায়া ছাড়া আর কোনো ছায়া থাকবে না।

 وَعَن أَبي هُرَيرَةَ رضي الله عنه، قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ ﷺ:« سَبْعَةٌ يُظِلُّهُمُ اللهُ في ظِلِّهِ يَوْمَ لاَ ظِلَّ إلاَّ ظِلُّهُ: إمَامٌ عَادِلٌ، وَشَابٌّ نَشَأ في عِبَادَةِ الله تَعَالَى، وَرَجُلٌ قَلْبُهُ مُعَلَّقٌ بِالمَسَاجِدِ، وَرَجُلاَنِ تَحَابّا في اللهِ اجْتَمَعَا عَلَيهِ وتَفَرَّقَا عَلَيهِ، وَرَجُلٌ دَعَتْهُ امْرَأةٌ ذَاتُ مَنصَبٍ وَجَمَالٍ، فَقَالَ: إنِّي أخَافُ الله، وَرَجُلٌ تَصَدَّقَ بِصَدَقَةٍ، فَأخْفَاهَا حَتَّى لاَ تَعْلَمَ شِمَالُهُ مَا تُنْفِقُ يَمِينُهُ، وَرَجُلٌ ذَكَرَ الله خَالِياً فَفَاضَتْ عَيْنَاهُ ». مُتَّفَقٌ عَلَيهِ .

আবু হুরাইরা রাদিয়াল্লাহু আনহু কর্তৃক বর্ণিত, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আল্লাহ তাআলা সাত ব্যক্তিকে সেই দিনে তার (আরশের) ছায়া দান করবেন; যেদিন তার ছায়া ব্যতীত আর কোন ছায়া থাকবে না। তারা হলো- ন্যায় পরায়ণ বাদশাহ (রাষ্ট্রনেতা), সেই যুবক যার যৌবন আল্লাহ তাআলার ইবাদতে অতিবাহিত হয়, সেই ব্যক্তি যার অন্তর মসজিদসমূহের সঙ্গে লটকে থাকে (মসজিদের প্রতি তার মন সদা আকৃষ্ট থাকে), সেই দুই ব্যক্তি যারা আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের উদ্দেশ্যে বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা স্থাপন করে; যারা এই ভালবাসার উপর মিলিত হয় এবং এই ভালবাসার উপরেই চিরবিচ্ছিন্ন (তাদের মৃত্যু) হয়। সেই ব্যক্তি যাকে কোনো কুলকামিনী সুন্দরী (ব্যভিচারের উদ্দেশ্যে) আহবান করে, কিন্তু সে বলে, আমি আল্লাহকে ভয় করি।’ সেই ব্যক্তি যে দান করে গোপন করে; এমনকি তার ডান হাত যা প্রদান করে, তা তার বাম হাত পর্যন্তও জানতে পারে না। আর সেই ব্যক্তি যে নির্জনে আল্লাহকে স্মরণ করে; ফলে তার উভয় চোখে পানি বয়ে যায়।’’ (বুখারি ৬৬০, ১৪২৩, ৬৪৭৯, ৬৮০৬, মুসলিম ১০৩১, তিরমিযি)

১. ন্যায়পরায়ণ শাসক: যারা ন্যায়পরায়ণতার সঙ্গে শাসন কাজ পরিচালনা করে তারা আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। এখানে শাসক বলতে সর্বস্তরের দায়িত্বশীল ব্যক্তিকে বোঝানো হয়েছে। তিনি পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বা কোনো দলের নেতা যাই হোন না কেন, নেতৃত্বের ব্যাপারে ন্যায় ও ইনসাফ করতে হবে।

হজরত মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন, ‘সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল এবং প্রত্যেকে তার দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসিত হবে।’ (বুখারি ও মুসলিম)। ইনসাফভিত্তিক নেতৃত্ব না হলে তা অধীনস্তদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি করে। নেতৃত্বের প্রতি অনীহা সৃষ্টির ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি মুসলমানদের যাবতীয় ব্যাপারে দায়িত্বশীল হওয়ার পর তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করবে, আল্লাহ তার জন্য বেহেশত হারাম করে দেবেন।’ (বুখারি ও মুসলিম)

২. আল্লাহর ইবাদতে মশগুল: যৌবনকাল মানুষের জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান সময়। এই সময় মানুষ যেকোনো দিকে ধাবিত হতে পারে। আর এই সময়ে যে আল্লাহর ইবাদত করবে, সে এই ছায়ার নিচে আশ্রয় পাবে।

৩. যার অন্তর মসজিদের সঙ্গে ঝুলে থাকে: অন্তর মসজিদের সঙ্গে ঝুলে থাকার অর্থ হলো আল্লাহর সঙ্গে সান্নিধ্য লাভের ব্যাপারে তার ব্যাকুলতা। দৈনিক পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ মসজিদে পড়ার জন্য ব্যাকুলতা। এক ওয়াক্ত নামাজ পড়ার পর আরেক ওয়াক্ত নামাজ কখন মসজিদে গিয়ে আদায় করবে, যার মনের মধ্যে এমন অস্থিরতা কাজ করবে সে আরশের ছায়ায় স্থান পাবে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নামাজ মুমিনদের জন্য মেরাজস্বরূপ।’ মসজিদে জামাতে নামাজ পড়ার গুরুত্ব অনেক।

৪. আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই বন্ধুত্ব রাখে: মুসলমানদের প্রত্যেকটি কাজ আল্লাহর উদ্দেশ্যে এবং ঈমানের পরিপূর্ণতার জন্যই হওয়া উচিত। কোনো কিছুকে ভালোবাসলে তা আল্লাহর জন্য এবং পরিত্যাগ করলে তাও আল্লাহর জন্য হতে হবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলুন আমার নামাজ (ইবাদতে বদনি বা শারীরিক ইবাদত), আমার কোরবানি (ইবাদতে মালি বা আর্থিক ইবাদত), আমার জীবন, আমার মরণ সবই একমাত্র আল্লাহর জন্য।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১৩২)। আবু উমামা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, যে ব্যক্তি কাউকে ভালোবাসা, ঘৃণা করা, দান করা ও দান না করা নিছক আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্যই হয়ে থাকে, সে ব্যক্তি পূর্ণ ঈমানদার। (বুখারি)

৫. ব্যভিচারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করলে: সেই ব্যক্তি পাবে আরশের ছায়া। যৌবনকালে নারী-পুরুষ একজন অন্যজনের সান্নিধ্য চায়। সৃষ্টিগতভাবে এটা একটা স্বাভাবিক কামনা। তখন সম্ভ্রান্ত ঘরের কোনো সুন্দরী রমণী ব্যভিচারে লিপ্ত হওয়ার প্রস্তাব করলে শুধু আল্লাহর ভয়েই তা থেকে বিরত থাকা যায়। এভাবে চরিত্রের হেফাজত করলেই আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করা যাবে।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর তোমরা ব্যভিচারের কাছেও যেও না। নিশ্চয়ই এটা অশ্লীল কাজ এবং অসৎ পন্থা।’ (সুরা বনি ইসরাইল : আয়াত ৩২)। তিনি আরও বলেন, ‘লজ্জাহীনতার যত পন্থা আছে তার কাছেও যেও না, তা প্রকাশ্যে হোক বা গোপনে হোক।’ (সুরা আনআম: আয়াত ১৫২)। ইসলাম বিবাহের মাধ্যমে বৈধ পন্থায় যৌন চাহিদা মেটানোর নির্দেশ দিয়েছে।

৬. গোপনে দান: আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্যই দান করা উচিত, মানুষের কাছে দাতা সাজার জন্য নয়। দান করার নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমাদের যে রিজিক দিয়েছি তা থেকে খরচ কর মৃত্যু আসার আগেই।’ (সুরা মুনাফিকুন : আয়াত ১০)। তিনি আরও বলেন, ‘তোমরা কিছুতেই কল্যাণ লাভ করতে পারবে না, যতক্ষণ না তোমরা তোমাদের প্রিয় বস্তুগুলোকে আল্লাহর পথে ব্যয় করবে।’ (সুরা আলে ইমরান : আয়াত ৯২)।

আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনই হবে দান করার মূল লক্ষ্য। প্রকাশ্যে দান করলে মনে অহংকার আসতে পারে, এ জন্যই গোপনে দান করার কথা বলা হয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহ তোমাদের সৌন্দর্য ও সম্পদের দিকে লক্ষ করেন না বরং তোমাদের অন্তঃকরণ ও কাজের দিকে লক্ষ করেন।’

৭. যে ব্যক্তি গোপনে আল্লাহকে স্মরণ করে: নির্জনে আল্লাহর ভয়ে দুই কারণে চোখের পানি ফেলা হয়। ক. আল্লাহর শ্রেষ্ঠত্ব ও মহত্তের জন্য। খ. নিজের অপরাধ স্মরণ করে মুক্তিলাভের জন্য।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে চোখের পানি ফেলেছে, তার জাহান্নামে প্রবেশ করা তেমনি অসম্ভব, যেমনি অসম্ভব দোহন করা দুধকে পুনরায় ওলানে প্রবেশ করানো। যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য তার পথে জিহাদ করেছে সে ব্যক্তি আর জাহান্নামের ধোয়া একত্র হবে না।’ (তিরমিজি)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেছেন, ‘দুই প্রকার চোখকে জাহান্নামের আগুন স্পর্শ করতে পারবে না। ১. ওই চোখ যা আল্লাহর ভয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয়। ২. ওই চোখ যা আল্লাহর পথে পাহারাদারিতে রাত জাগে।’ (বুখারি)

দুনিয়ার জীবনে এমন নেক আমলই আমাদের সবার করা উচিত কেয়ামতের দিন যেন আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান পেতে পারি।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়