ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৩ ১৪৩১

যেসব প্রচলিত ভুলে বাতিল হতে পারে কোরবানি

ইসলাম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১০:১৯, ৩ জুলাই ২০২২  

সংগৃহীত

সংগৃহীত

আলহামদুলিল্লাহ, প্রতি বছরের ন্যায় এ বছরও কোরবানির প্রাক প্রস্তুতি শুরু হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে অনেকে বিভিন্নভাবে প্রস্তুতি নেয়া শুরু করেছেন। আমাদের দেশে বহু লোক প্রতি বছর কোরবানি করে থাকেন। বরং ইসলামের অন্য কোনো আমল এতো পরিমাণ হয় না, যতো পরিমাণ কোরবানি মানুষ করে থাকে। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো- এক্ষেত্রে অনেকে বিভিন্ন ভুল করে থাকেন। যার দরুন সওয়াব লাভ তো দূরে থাক তাদের কোরবানি বিশুদ্ধই হয় না। এজন্য কোরবানির কিছু ভুল দিক নিয়ে আলোচনা করছি:-

১. কোরবানির ব্যাপারে নিজের ধ্যান-ধারণা পরিষ্কার রাখা।
কোরবানির ব্যাপারে দু’ধরনের ধারণা পাওয়া যায়। একটি ইসলামী ধারণা। অপরটি জাহেলী ধারণা। সুতরাং জাহেলী ধারণা হলো- কোনো মূর্তি বা দেব-দেবীর সন্তুষ্টি লাভের জন্য কিংবা জিন-শয়তান বা কোনো অশুভ শক্তির আকস্মিক অনিষ্ট থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য তাদের উদ্দেশে কোনো কিছু উৎসর্গ করা। এটা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন কুসংস্কার এবং সম্পূর্ণ শিরক ও হারাম।

ইসলাম ধর্মে তার কোনো সুযোগ নেই। মহানবী সা:-এর আগমনের পূর্বে আরবে বিভিন্ন প্রতিমার নামে পশু উৎসর্গ করার প্রথা ছিল। ইসলাম আসার পরে এসব নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তয়ালা বাহিরা, (ওই প্রাণী যার দুধ প্রতিমার উদ্দেশে উৎসর্গ করা হতো) সায়েবা,( প্রতিমার নামে উৎসর্গ করা সে উটনী যার ওপর সাওয়ার হওয়া, পশম কাটা, দুধ পান করা নিষেধ) ওসীলা,( ওই বকরী যা প্রতিমার উদ্দেশে ছেড়ে দেয়া হতো) ও হামীকে (প্রতিমার উদ্দেশে ছেড়ে দেয়া পুরুষ উট) শরীয়ত সিদ্ধ করেননি।’ (সূরা মায়েদা, আয়াত : ১০৩)।

ইসলাম জাহেলী যুগের এসব কু-প্রথাকে বিলোপ করে একমাত্র আল্লাহর উদ্দেশে কোরবানি করার নির্দেশ দিয়েছে। আর ইসলামী ধারণার কোরবানির অর্থ হলো- আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি ও নৈকট্য অর্জনের জন্য শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত কোনো প্রিয় বস্তু আল্লাহ তাআলার দরবারে পেশ করা এবং শরীয়ত নির্দেশিত পন্থায় তা ব্যবহার করা।

আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, ‘তোমার পালনকর্তার উদ্দেশে নামাজ পড় এবং কোরবানি কর।’ (সূরা কাউছার, আয়াত ২)।

এ আয়াতে নামাজ ও কোরবানিকে একসাথে উল্লেখ করে এদিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে যে, নামাজ যেমন আল্লাহ ছাড়া অন্য কারো উদ্দেশে পড়া যায় না, কোরবানিও তেমনিভাবে অন্য কারো উদ্দেশে করা যায় না। এজন্য কোরবানির ক্ষেত্রে আমাদেরকে জাহেলী ধারণা বাদ দিয়ে ইসলামী ধারণা গ্রহণ করতে হবে।

২. নিয়ত বিশুদ্ধ করা।
আমরা বিভিন্ন নিয়তে কোরবানি করে থাকি, কেউ কোরবানি করি সামাজিক মর্যাদা হিসেবে। সমাজে আমার বিশেষ মর্যাদা রয়েছে, সুতরাং কোরবানি না দিলে আমার মর্যাদা থাকবে না। কেউ কোরবানি করি চক্ষু লজ্জা থেকে বাঁচতে। কেউ কোরবানি করি গোস্ত খেতে ইত্যাদি ইত্যাদি । এ জাতীয় উদ্দেশে কোরবানি করলে কোরবানি কবুল হবে না। বরং আমি ছোট ও বড় যে পশুই কোরবানি করি তা যেন আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের জন্য হয়, অন্য কোন উদ্দেশে যেন না হয়।

আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, এ‘গুলোর গোস্ত ও রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছে না, পৌঁছে তোমাদের অন্তরের তাকওয়া।’ (সূরা হজ্জ, আয়াত ৩৭)।

৩. আল্লাহর নামে কোরবানি দেয়া।
সাধারণত আমাদের সমাজে ব্যক্তির নামে কোরবানির কথা বলা হয় যেমন অমুকের নামে, বাবার নামে অথবা মায়ের নামে কোরবানি দেব। এমনটা বলা ঠিক নয়। কারণ, কোরবানি একটি আর্থিক ইবাদত, যা হবে আল্লাহর নামে, ব্যক্তির নামে নয়। এজন্য বলা যেতে পারে অমুকের পক্ষ থেকে আল্লাহর নামে কোরবানি। যদিও কারো নামে কোরবানির দ্বারা তার পক্ষ থেকে আদায় করা উদ্দেশ্য হয়, তারপরও এমনটি না বলা।

আল্লাহ তয়ালা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা তা ভক্ষণ করো না যেগুলো আল্লাহর নাম ব্যতীত অন্যের নামে যবাই করা হয়।’ (সূরা আনআম, আয়াত ১২১)।

৪. হাসিল ছাড়া কোরবানি করা।
অনেকে মনে করেন হাসিল না দিলে কোরবানি হবে না। এ ধারণা ঠিক নয়। হাসিল হাটের ভাড়া। এটি হাট কর্তৃপক্ষের হক। যা হাটের সুবিধা গ্রহণের বিনিময়ে নেয়া হয়। তাই এ টাকা পরিশোধ করা জরুরি। হাসিল না দিলে হাট কর্তৃপক্ষের হক নষ্ট করার গোনাহ হবে।

৫. পশু জাবাই করার জন্য ধারাল ছুরির ব্যবস্থা করা।
আমরা কোরবানির পশু জবাই করার জন্য হুজুরদের ছুরির দিকে তাকিয়ে থাকি। তার ছুরি তো একটা। এজন্য প্রথমে যেগুলো জবাই করেন সেগুলো যত সুন্দরভাবে জবাই হয় পরের গুলো তেমন হয় না। এজন্য কোরবানির অন্যান্য প্রয়োজনীয় বস্তুর সাথে ধারাল ছুরির ব্যবস্থা করা।

নবী সা: ইরশাদ করেন, ‘আল্লাহ তায়ালা সব কিছুর ওপর অনুগ্রহকে অপরিহার্য করেছেন। অতএব, যখন তোমরা (কাউকে শরীয়ত মোতাবেক হদ বা কিসাস হিসেবে) হত্যা করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে হত্যা কর, যখন জবাই করবে তো উত্তম পদ্ধতিতে জবাই কর। এবং প্রত্যেকে তার ছুরিতে শান দিবে। যেন জবাইয়ে প্রাণীর বেশি কষ্ট না হয়। (সহীহ মুসলিম, হাদিস : ১৯৫৫)।

৬. নিজের পশু নিজেই জবাই করা।
অনেকে মনে করেন ইমাম বা মাদরাসার ছাত্র দ্বারা জবাই করা জরুরি। আসলে বিষয়টা এমন নয়। বরং নিজে জবাই করা মুস্তাহাব। অক্ষম হলে অন্য কোনো মুসলমান দিয়ে জবাই করা যেতে পারে। তবে ইমাম, ওলামায়ে কেরাম ও ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসার কারণে তাদের দ্বারা কোরবানি করালে দোষের কিছু নেই।

হজরত আনাস ইবনে মালেক বলেন রাসূল সা: দু’টি সাদা-কালো বর্ণের দুম্বা কোরবানি করেছেন এবং ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলেছেন। আর আমি দেখেছি যে, তিনি দুম্বা দুটির গর্দানে পা রেখে নিজ হাতে সেগুলো জবাই করেছেন। (সহীহ বুখারি, হাদিস : ৫৫৫৮)

৭. কোরবানির সময় দাতাদের নাম পাঠ করা জরুরি?
কোরবানির সময় দাতাদের নাম কাগজে লিখে হাতে নিয়ে পাঠ করাকে অনেকে জরুরি মনে করেন। অথচ কোরআন ও হাদীসে এর কোনো ভিত্তি নেই। বরং যাদের পক্ষ থেকে কোরবানি হচ্ছে তা আল্লাহ তায়ালা ভালো করে জানেন। আল্লাহ তায়ালা কোরআন মাজীদে ইরশাদ করেন, ‘নিশ্চয়ই তিনি জানেন প্রকাশ্য ও গোপন বিষয়।’ (সূরা আলা, আয়াত : ৭)।

৮. জবাইয়ের পূর্বে লম্বা দোয়া পড়া কি জরুরি?
আমরা অনেকেই এই অজুহাতে কোরবানি করি না যে, আমার তো দোয়া মুখস্থ নেই। অথচ জবাইয়ের পূর্বে হাদীসে বর্ণিত দোয়াটি পড়া উত্তম; জরুরি নয়। ‘বিসমিল্লাহি আল্লাহু আকবর’ বলে জবাই করলে পশু জবাই শুদ্ধ হয়ে যাবে। (বুখারি শরিফ, হাদিস : ৫২৩৮)।

৯. জবাইকারী ও তার সহযোগীদের বিসমিল্লাহ পড়া জরুরি।
জবাইকারী এবং তার সাথে সহযোগীরা যদি জবাইয়ের সময় ছুরিতে হাত লাগায়, তাহলে প্রত্যেককে বিসমিল্লাহ বলতে হবে। এদের কেউ যদি ইচ্ছাপূর্বক জবেহের সময় বিসমিল্লাহ না পড়ে তাহলে পশু কোরবানি হবে না। (রদ্দুল মুহতার, পৃষ্ঠা : ৬/৩৩৪)। আমরা অনেকেই এ মারাত্মক ভুল করি।

১০. যবাইয়ের সময় পশুর চারটি রগের তিনটি কাটা নিশ্চিত করতে হবে।
অনেক সময় জবাইকারী একটু জবাইয়ের পর কসাই ভাইয়েরা ছোট ছুরি দিয়ে পশুর গলায় ছুরি দিয়ে জোরে আঘাত করেন, যা সম্পূর্ণ নাজায়েয ও গর্হিত কাজ। এতে পশু জবাই হলো না বরং আঘাতে হত্যা করা হলো।

এজন্য প্রাণীর চারটি রগের মধ্যে কমপক্ষে তিনটি রগ কাটা নিশ্চিত করতে হবে। চারটি রগ হলো- শ্বাসনালি, খাদ্যনালি ও দুটি রক্তনালি বা শাহরগ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়