ঢাকা, মঙ্গলবার   ১৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ৪ ১৪৩০

শাওয়াল মাসের ফজিলত ও আমল

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৩:০১, ১৭ মে ২০২১  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

রমজানের রোজা রাখার পর শাওয়াল মাসের ছয়টি রোজা রাখা সুন্নত-মুস্তাহাব। শাওয়াল মাসে ছয়দিন রোজা রাখার বিধান হাদিস শরিফে বর্ণিত হয়েছে। এ রোজা পালনের মর্যাদা অনেক বড়, এতে অনেক সওয়াব রয়েছে। যে ব্যক্তি এ রোজাগুলো পালন করবে সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল। এ বিষয়ে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম হতে সহিহ হাদিস বর্ণিত হয়েছে।

আবু আইয়ুব (রা.) হতে বর্ণিত হাদিসে এসেছে রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের রোজা রাখল এরপর শাওয়াল মাসে ছয়টি রোজা রাখল সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল।’ (সহিহ মুসলিম, সুনানে আবু দাউদ, জামে তিরমিজি, সুনানে নাসায়ী ও সুনানে ইবনে মাজাহ) এ হাদিসকে নবী (সা.) অন্য বাণী দিয়ে ব্যাখ্যা করেছেন তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি ঈদুল ফিতরের পরে ছয়দিন রোজা রাখবে সে যেন গোটা বছর রোজা রাখল: যে ব্যক্তি একটি নেকি করবে সে দশগুণ সওয়াব পাবে।’ 

অন্য বর্ণনাতে আছে- ‘আল্লাহ এক নেকিকে দশগুণ করেন। সুতরাং এক মাসের রোজা দশ মাসের রোজার সমান। বাকী ছয়দিন রোজা রাখলে এক বছর হয়ে গেল।’ (সুনানে নাসায়ী, সুনানে ইবনে মাজাহ) হাদিসটি সহিহ আত-তারগীব ও তারহীব (১/৪২১) গ্রন্থেও রয়েছে। সহিহ ইবনে খুজাইমাতে হাদিসটি এসেছে এ ভাষায়- ‘রমজান মাসের রোজা হচ্ছে দশ মাসের সমান। আর ছয়দিনের রোজা হচ্ছে- দুই মাসের সমান। এভাবে এক বছরের রোজা হয়ে গেল।’

শাওয়াল হলো আরবি চন্দ্র বছরের দশম মাস। এটি হজের তিন মাসের (শাওয়াল, জিলকদ, জিলহজ) প্রথম মাস; এই মাসের প্রথম তারিখে ঈদুল ফিতর বা রোজার ঈদ। পয়লা শাওয়ালে সদকাতুল ফিতর বা ফিতরা আদায় করা এবং ঈদের নামাজ পড়া ওয়াজিব। এই মাসের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে হজের, এর সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে ঈদের, এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে রোজা ও রমজানের এবং এর সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে সদকা ও জাকাতের। তাই এই মাস আমল ও ইবাদতের জন্য অত্যন্ত উর্বর ও উপযোগী।

শাওয়ালের অর্থ ও তাৎপর্য
‘শাওয়াল’ আরবি শব্দ। এর অর্থ হলো উঁচু করা, উন্নতকরণ, উন্নত ভূমি, পূর্ণতা, ফলবতী, পাল্লা ভারী হওয়া, গৌরব করা, বিজয়ী হওয়া, প্রার্থনায় হস্ত উত্তোলন করা বা ভিক্ষায় হস্ত প্রসারিত করা, পাত্রে অবশিষ্ট সামান্য পানি, ফুরফুরে ভাব, দায়ভারমুক্ত ব্যক্তি, ক্রোধ প্রশমন ও নীরবতা পালন, সিজন করা কাঠ। এসব অর্থের প্রতিটির সঙ্গেই শাওয়ালের সুগভীর সম্পর্ক রয়েছে। এই মাসের আমলের দ্বারা উন্নতি লাভ হয়, পূর্ণতা ফল লাভ হয়, নেকির পাল্লা ভারি হয়, গৌরব অর্জন হয় ও সাফল্য আসে, ফলপ্রার্থী আল্লাহর কাছে হস্ত সম্প্রসারিত করে প্রার্থনা করে, পূর্ণ মাস রোজা পালনের পর আরও কয়েকটি রোজা রাখে, প্রাপ্তির আনন্দে বিভোর হয়, ফরজ রোজা পালন শেষে নফল রোজার প্রতি মনোনিবেশ করে, আত্মনিয়ন্ত্রণের শক্তি অর্জন করে, পরিপক্বতা ও স্থিতি লাভ করে। এসবই হলো শাওয়াল মাসের নামের যথার্থতা।

শাওয়াল মাসের সুন্নত
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিস দ্বারা প্রমাণিত: শাওয়াল মাসে বিয়েশাদি সুন্নত, যেরূপ শুক্রবারে ও জামে মসজিদে ও বড় মজলিশে আক্দ অনুষ্ঠিত হওয়া সুন্নত। কারণ, মা আয়েশার বিয়ে শাওয়াল মাসের শুক্রবারে মসজিদে নববীতেই হয়েছিল। ছয় রোজা শাওয়াল মাসের বিশেষ সুন্নত। (সহিহ মুসলিম শরিফ)।

ছয়টি সুন্নত রোজা  
এই মাসে ছয়টি নফল রোজা রাখা সুন্নত। রাসূল (সা.) বলেন: যারা রমজানে রোজা পালন করবে এবং শাওয়ালে আরও ছয়টি রোজা রাখবে; তারা যেন সারা বছরই রোজা পালন করল। (মুসলিম, হাদিস: ১১৬৪; আবু দাউদ, হাদিস: ২৪৩৩; তিরমিজি, নাসায়ি, ইবনে মাজাহ, সহিহ-আলবানি)। শাওয়াল মাসের এ ছয়টি রোজা মূলত সুন্নত। যেহেতু রাসূল (সা.) নিজে তা আমল করেছেন এবং আমল করার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু পরিভাষায় এগুলোকে নফল রোজা বলা হয়। কারণ, এগুলো ফরজ ও ওয়াজিব নয়, অতিরিক্ত তথা নফল।

কাজা রোজা ও সুন্নত বা নফল রোজা
রমজান মাসের কাজা রোজা সম্পর্কে মহান আল্লাহ তায়ালা কোরআনে বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে যে অসুস্থ থাকবে কিংবা সফরে থাকবে সে (রমজানের পরে) অন্য দিনগুলোতে রোজা রাখতে পারবে।’ (সুরা-২ বাকারা, আয়াত: ১৮৪)। তাই যারা সফরের ক্লান্তির কারণে কিংবা অসুস্থ থাকার কারণে রমজানে পূর্ণ রোজা রাখতে পারেননি, তারা সেগুলো রমজানের পর অন্য সময়ে আদায় করে নেবেন। আর ওই অসুস্থতার মধ্যে নারীদের ঋতুমতী হওয়াও শামিল। এ বিষয়ে মা আয়েশা (রা.) বলেন, আমরা রাসূল (সা.)-এর যুগে ঋতুমতী হতাম। তখন আমাদের এই রোজা পরে কাজা আদায় করার নির্দেশ দেয়া হতো; কিন্তু নামাজ কাজা আদায় করার কথা বলা হতো না। (অর্থাৎ ওই অবস্থায় নামাজ মাফ, কিন্তু রোজা মাফ নয়। তা পরে আদায় করে নিতে হবে)। (বুখারি ও মুসলিম; মিশকাত, হাদিস: ২০৩২)।

হজরত আয়েশা (রা.) বলেন, আমার ওপর রমজানের যে কাজা রোজা বাকি থাকত, তা পরবর্তী শাবান মাস ব্যতীত আমি আদায় করতে পারতাম না। (বুখারি, হাদিস: ১৯৫০; মুসলিম, হাদিস: ১১৪৬)। এই হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, রমজানের ছুটে যাওয়া কাজা রোজা পরবর্তী রমজান মাস আসার আগে যেকোনো সময় আদায় করা যাবে। রমজানের কাজা রোজা রাখার জন্য সময় সংকীর্ণ না হলে তার আগে নফল রোজা রাখা বৈধ ও শুদ্ধ। অতএব সময় যথেষ্ট থাকলে ফরজ রোজা কাজা করার আগে নফল রোজা রাখতে পারবেন। যেমন, ফরজ নামাজ আদায় করার আগে সময় থাকলে নফল নামাজ আদায় করতে পারেন।

তাই শাওয়ালের ছয়টি সুন্নত রোজা রমজানের কাজা রোজা আদায়ের আগেও রাখা যাবে। যেমন, হজরত আয়েশা (রা.) আমল করতেন। তবে সম্ভব হলে আগে ফরজ রোজার কাজা আদায় করাই উত্তম। (ফাতাওয়া ইসলামিয়্যাহ, খন্ড: ২, পৃষ্ঠা: ১৬৬)।

এই দুই রোজা এক নয়
শাওয়াল মাসে কাজা রোজা আদায় করলে এবং এর সঙ্গে নফলের নিয়ত করলে ফরজ আদায়ের পাশাপাশি নফল রোজা (একের দ্বারা উভয়) পালন হবে না। কারণ, একদিকে এটি যুক্তিযুক্ত নয়, অন্যদিকে বোধগম্যও নয়। সর্বোপরি এটি নবী করিম (সা.) এবং সাহাবায়ে কেরামের আমলও নয়। চন্দ্র মাস হিসেবে ৩৫৪ বা ৩৫৫ দিনে এক বছর হয়। প্রতিটি নেক আমলের সওয়াব আল্লাহ রাব্বুল আলামিন কমপক্ষে ১০ গুণ করে দিয়ে থাকেন। এই হিসাবে রমজান মাসে এক মাসের (৩০ দিনের) রোজা ১০ গুণ হয়ে ৩০০ দিনের সমান হয়। অবশিষ্ট ৫৪ বা ৫৫ দিনের জন্য আরও ছয়টি পূর্ণ রোজার প্রয়োজন হয় (যেহেতু অর্ধেক বা অর্ধদিবস রোজা নেই)।

তাই রমজানের (৩০) রোজার কাজা থাকলে তা পূরণ করলে তো মাত্র ৩০টিই হলো, আর ছয়টি কোথায়? তাই রমজানের ৩০ রোজা পূর্ণ করতে হবে এবং আলাদা ছয়টি সুন্নত নফল রোজাও পালন করতে হবে; তবেই পূর্ণ বছরের রোজা গণ্য হবে। অযৌক্তিক ও দুর্বোধ্য কৌশল অবলম্বন করা নিজেকে ঠকানো বা আত্মপ্রবঞ্চনার নামান্তর বই কিছুই নয়। নবীজি (সা.) যে হিসাব করে এই ছয়টি নফল (অতিরিক্ত) রোজা সুন্নত করলেন, সে সূত্রকে উপেক্ষা করে নিজেদের সুবিধামতো ব্যাখ্যা করা প্রকৃতপক্ষে অসুবিধা ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা ছাড়া আর কিছুই নয়।

হাদিস শরিফে আছে, কিয়ামতের দিনে হাশরের ময়দানে কোনো আদমসন্তান পাঁচটি প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে এক কদমও নড়তে-চড়তে পারবে না। প্রশ্ন পাঁচটি হলো: জীবন, যৌবন, আয়, ব্যয় ও জ্ঞান। (তিরমিজি, ২/ ৬৭; আরবাইন, নববি: ১৯, ২০ ও ২১)। এখানে দেখা যাচ্ছে সর্বশেষ ও চূড়ান্ত প্রশ্ন হলো জ্ঞান বা বিবেকের সঠিক ব্যবহার বা প্রয়োগ ও তার অনুসরণ করা হয়েছে কি না। অতএব বিবেক বা জ্ঞানের সীমা লঙ্ঘন করা মুমিন বা মুসলিমের কাজ নয়।

শাওয়াল মাসে রোজা রাখার নিয়ম
মাসের যেকোনো সময় এই রোজা আদায় করা যায়। ধারাবাহিকভাবে বা মাঝে মাঝে বিরতি দিয়েও আদায় করা যায়। উল্লেখ্য, রমজান মাসে ফরজ রোজা ছাড়া অন্য সব রোজার নিয়ত সাহরির সময়ের মধ্যেই করতে হবে। ঘুমানোর আগে বা তারও আগে যদি এই দিনের রোজার পাক্কা ইচ্ছা বা দৃঢ় সংকল্প থাকে, তাহলে নতুন নিয়ত না হলেও চলবে এবং সাহরি না খেতে পারলেও রোজা হবে। (ফাতাওয়া শামী) 

সর্বশেষ
জনপ্রিয়