ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১২ ১৪৩১

শিক্ষা মাতৃভাষাতেই প্রয়োজন

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ০৯:৪৭, ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তিনি প্রথমজীবনে মাতৃভাষা বাংলাতেই ভূগোল, ইতিহাস, গণিত, প্রাকৃত-বিজ্ঞান, ব্যাকরণ ইত্যাদি শিখেছিলেন। আর ‘আগে চাই বাংলা ভাষার গাঁথুনি, তারপরে ইংরেজি শেখার পত্তন’-  এই কথাটিতো রবীন্দ্র-প্রসঙ্গে প্রবচনে পরিণত হয়েছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে এই এক ভাষাকেন্দ্রিক শিক্ষার সূচনা না করা গেলে পাঠে ছাত্রছাত্রীদের আনন্দ থাকবে না। যেমন, বাংলাদেশে বাংলা ভার্সন ও ইংরেজি ভার্সনের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটি বড়ো পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। বাংলা ভার্সনের শিক্ষার্থীরা বিষয়টির যতটা গভীরে প্রবেশ করতে পারে, ইংলিশ ভার্সনের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশই তা পারে না। কারণ, ভাষা নিয়ে ইংলিশ ভার্সনের ছাত্রদের বাড়তি চাপ সহ্য করতে হয়। তাই আনন্দও তিরোহিত হয় তাদের। তারা শুধু তথ্য জানে, সত্য জানতে চায় না; আগুন জ্বালাবার আয়োজন করে, আগুন জ্বালাতে পারে না।

রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, ‘আমাদের শিক্ষার মধ্যে এমন একটি সম্পদ থাকা চাই যা কেবল আমাদের তথ্য দেয় না, সত্য দেয়; যা কেবল ইন্ধন দেয় না, অগ্নি দেয়।’ বাংলাদেশের ভবিষ্যতের শিক্ষায় রবীন্দ্র কথিত সেই ‘সম্পদ’টিই সংযোজন করা জরুরি, যা জীবনসত্যকে অনুধাবন করতে শেখাবে; যা চেতনাগ্নিকে ছড়িয়ে দেবে দিক থেকে দিগন্তে!

‘বিদ্যা যে দেবে এবং বিদ্যা যে নেবে তাদের উভয়ের মাঝখানে যে সেতু সেই সেতুটি হচ্ছে ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ। সেই আত্মীয়তার সম্বন্ধ না থেকে যদি কেবল শুষ্ক কর্তব্য বা ব্যবসায়ের সম্বন্ধই থাকে তাহলে যারা পায় তারা হতভাগ্য, যারা দেয় তারাও হতভাগ্য।’- এটা রবীন্দ্রবচন; শুধু বচন নয়, উপলব্ধি। এখানে দুটো খুব গুরুত্বপূর্ণ শব্দবন্ধ আছে: ‘ভক্তিস্নেহের সম্বন্ধ’; ‘আত্মীয়তার সম্বন্ধ’। রবীন্দ্রনাথ মনে করেন বিদ্যাশিক্ষার জন্য এ দুটো খুব জরুরি; এর অভাবে বিদ্যাশিক্ষা হবে না। বিদ্যাশিক্ষা বলতে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষাই বোঝানো হয়েছে। পরে তিনিও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়েছিলেন এবং সেখানে ঐ দুটো প্রতীতির বাস্তবায়ন চেয়েছিলেন। তবে, তাঁর নিজের যে প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যাশিক্ষা হয়নি, সেটা কি তাহলে এজন্য? হবে হয়তো। পুরো রবীন্দ্ররচনায় তাই তাঁর শিক্ষকদের নিয়ে খুব একটা উচ্চভাষ্য নেই। বরং রবীন্দ্ররচনায় শিক্ষকদের চিত্র ও চরিত্র স্বল্প এবং অনুল্লেখযোগ্য। নিজের শিক্ষা নিয়ে অতৃপ্তি মেটাতেই কি তাহলে ‘বিশ্বভারতী’ গড়েন রবীন্দ্রনাথ? নিজহাতে করেন সেই প্রতিষ্ঠানের শিক্ষাদানের ‘মডেল’? কী পড়ানো হবে, কারা পড়াবেন নির্বাচন করেন নিজে; বেছে বেছে শিক্ষকমণ্ডলী আনেন, যাঁরা শিক্ষায় জীবন নিবেদন করতে চান তাঁদের? ব্রিটিশ শিক্ষাপদ্ধতির বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে তাদের সঙ্গে টেক্কা দেবার ভারতীয় বিদ্যা ও শিক্ষাকে তিনি ঊর্ধ্বে তুলে ধরেন, যদিও ঔপনিবেশের সেটা শেষলগ্ন। হোক। তবুতো প্রতিবাদী হয়ে দাঁড়ালেন রবীন্দ্রনাথ পাশ্চাত্য শিক্ষার বিরুদ্ধে ভারতীয় শিক্ষা নিয়ে।

ইংরেজধারায় প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতীয় প্রচলিত ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লোপ পেতে থাকে। এর শুরু হয়েছিল মুসলিম শাসনামলে। পারসি ভাষা যখন ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়, সে-সময় থেকেই একশ্রেণির হিন্দু সন্তানদের সরকারি চাকরি ও সমর্থন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পারসি শিখিয়েছেন। ধর্মীয়ভাবে বিরোধ হবে এমন ভাবেননি।

রবীন্দ্রনাথের সাহসটা এলো কোত্থেকে? এলো, ভারতের চিরায়ত শিক্ষাব্যবস্থার নির্যাস থেকে। প্রাচীন ভারতের ইতিহাস তাঁর জানা ছিল, পড়া ছিল উপনিষদ থেকে শুরু করে প্রাচীন ভারতীয় গ্রন্থাদি। তিনি জানতেন জ্যোতির্বিদ্যা ও ভৌতবিজ্ঞানে প্রাচীন ভারতীয়রা বিশ্বসেরা ছিল; সূর্য-চন্দ্র-গ্রহাদি সম্পর্কে জ্ঞান ছিল তাদের; কালগণনার রীতি ও পদ্ধতি তারা জানত; গণিতের শূন্যের ধারণা ভারতীয়দের; জ্যামিতিতে অধিকার ছিল তাদের প্রশ্নাতীত আর অথর্ব বেদে চিকিৎসা সংক্রান্ত যে জ্ঞান ছিল তা ঈর্ষণীয়। কিন্তু কীভাবে এগুলো সেসময় সম্ভবপর হয়েছিল?

হিউয়েন সাঙের বিবরণ থেকে মগধের নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি চমৎকার ও মনোমুগ্ধকর চিত্র পাওয়া যায়। নালন্দার প্রধান আকর্ষণ ছিল তার গ্রন্থাগার এবং বিদগ্ধ অধ্যাপকমণ্ডলী। সেখানকার গ্রন্থাগারকে বলা হতো জ্ঞানবিপণি। নালন্দায় পড়বার যোগ্যতা সবার ছিল না। যাদের ছিল তাদের মধ্যে শতকরা মাত্র কুড়িজনকে প্রবেশাধিকার দেওয়া হতো। এতো কড়াকড়ির পরও, হিউয়েন সাঙ জানাচ্ছেন, নালন্দার ছাত্রসংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার। তাহলে বোঝাই যাচ্ছে, যোগ্যতা আছে পঁচিশ হাজারের কিন্তু প্রবেশাধিকার মিলছে পাঁচ ভাগের একভাগের। সমতট রাজবংশের সন্তান মহাজ্ঞানী শীলভদ্র ছিলেন নালন্দার প্রধান আচার্য। যদিও এখানে মূলত বৌদ্ধ মহাজ্ঞানদর্শনের চর্চা হতো তবু বেদ, সাংখ্য, ব্যাকরণ, গণিত, সাহিত্য, চিকিৎসাবিদ্যা ছিল তাদের পাঠ্য বিষয়। প্রতিদিন একশটি ঘরে একশজন অধ্যাপক অধ্যাপনা করতেন। অর্থাৎ প্রতিদিনই লেখাপড়া হতো, প্রতিঘরেই শিক্ষক থাকতেন কিন্তু তাঁরা ঘর-বদল করতেন। খেলাধুলাও ছিল এর অংশ। ভারতের বাইরে চীন ও তিব্বত থেকেও ছাত্র ও শিক্ষক আসতেন এই প্রতিষ্ঠানে শিক্ষাগ্রহণ করার জন্য। হিউয়েন সাঙ নিজেই পাঁচ বছর অধ্যাপনা করেছেন নালন্দায়। রাজা হর্ষবর্ধনের রাজত্বকালে চীনদেশীয় এই পণ্ডিত হিউয়েন সাঙ ভারতে আসেন এবং প্রায় চৌদ্দ বছর (৬৩০-৪৪ খ্রিষ্টাব্দ) অবস্থান করেন। তিনি নালন্দার বর্ণনা দিয়েছেন। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের বাইরেও যে শিক্ষাবিস্তারের প্রতিষ্ঠান ছিল, তা অনুমান করা অসঙ্গত নয়।

হিউয়েন সাঙের গ্রন্থ সি-ইউ-কি পাঠ করলে জানা যায়, বাংলার সমাজ-শিক্ষা-অর্থনীতি এবং মানবচরিতের নানা বিষয়। সে সময় বাংলায় চলে পাল শাসন। ধর্মপাল ওদন্তপুরে একটি মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্র ও দর্শন পাঠের জন্য এই বিহার খুবই বিখ্যাত হয়। এর জ্ঞানবিপণি বা গ্রন্থাগার বিশেষভাবে সমৃদ্ধ হয়েছিল। যারা মেধাবী, সেই ছাত্রদের বিনা অর্থে পড়ানোর ব্যবস্থা ছিল। বিখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত শীলরক্ষিত ওদন্তপুর মহাবিহারের আচার্য নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিক্রমপুরের আদিনাথ চন্দ্রগর্ভ মাত্র উনিশ বছর বয়সে সেই মহাবিহারে বিদ্যাশিক্ষার জন্য যান। এই আদিনাথই পরে ভারতশ্রেষ্ঠ বৌদ্ধপণ্ডিত ও দার্শনিক দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান হয়েছিলেন; তিনি অতীশ দীপঙ্কর নামেও সমধিক পরিচিত। ওদন্তপুর মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই তিনি ‘শ্রীজ্ঞান’ উপাধি লাভ করেন। সম্রাট ধর্মপাল বর্তমান ভারতের অন্তর্গত ভাগলপুরের কাছে বিক্রমশীল নামে আরও একটি মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তাই বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্তর্ভুক্ত ছিল ছয়টি মহাবিদ্যালয়। বিক্রমশীলে শতাধিক অধ্যাপক পাঠদান করতেন আর তিন হাজারের বেশি ছাত্র ছিল। ন্যায়শাস্ত্র, ধর্মশাস্ত্র, জ্যোতিষশাস্ত্র, ব্যাকরণবিদ্যা, চিকিৎসাবিদ্যার পাঠ দেওয়া হতো এই মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিব্বতী ছাত্রদের বেশ আকর্ষণ করতে পেরেছিল এই প্রতিষ্ঠানটি। সেখান থেকে প্রচুর সংখ্যক ছাত্র এসেছে বলে তিব্বতীদের জন্য আলাদা ছাত্রাবাস নির্মাণ করতে হয়েছিল। ছাত্রাবাসগুলোকে তখন বলা হতো মঠ। সম্পূর্ণ আবাসিক সুবিধাসমেত মঠগুলোতে ছাত্ররা আবাসিকভাবে অবস্থান করে বিদ্যাশিক্ষা করত। বিদ্যাশিক্ষা সম্পন্ন হলে পালসম্রাট স্বয়ং উপস্থিত হয়ে কৃতী ছাত্রদের উপাধি দান করতেন। আচার্য ও কৃতী ছাত্রদের ছবি এঁকে তা মহাবিদ্যালয়গৃহে টানিয়ে রাখা হতো। বাঙালি পণ্ডিত অভয়ঙ্কর গুপ্ত বিক্রমশীল মহাবিহারের প্রধান আচার্য ছিলেন। দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান, জেতারি রত্নাকর প্রমুখ বাঙালি মনীষী এই বিহারের শিক্ষক ছিলেন। এই বিহারে শিক্ষাপ্রাপ্ত শান্তিরক্ষিত, পদ্মসম্ভব, কমলশীল প্রমুখ বাঙালি ধর্ম প্রচারার্থে তিব্বতে গিয়েছিলেন। সম্রাট ধর্মপাল সোমপুরেও মহাবিহার স্থাপন করেছিলেন। রাজশাহিতে পাহাড়পুরের সোমপুর মহাবিহারের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। তিব্বতের লেখক লামা তারানাথ উল্লেখ করেছেন, ধর্মপাল পঞ্চাশটি শিক্ষাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। উল্লেখ্য লামা একটি সম্প্রদায়। বাঙালি ধর্মপ্রচারকগণ তিব্বতে ধর্মপ্রচার করে যে জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছিলেন, তাদেরই লামা বলা হয়। পালযুগে বঙ্গদেশ ভারতীয় সংস্কৃতির একটি প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল বিদ্যাশিক্ষা প্রদানের মাধ্যমে। বিশেষত তিব্বত, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া, চায়না- এই অঞ্চলের মানুষেরা বঙ্গদেশকে শিক্ষা ও সংস্কৃতির আধার বলে মনে করে ছাত্র পাঠাত। তখন বৈদিক সাহিত্য, মীমাংসা, ব্যাকরণ, তর্কশাস্ত্র, বেদান্ত, প্রমাণশাস্ত্র শিক্ষা দেওয়া হতো।

ব্রিটিশ শাসনামল থেকে দেশে অদ্যাবধি শিক্ষার যে বিভিন্ন ধারা সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো বিশেষ আশার সঞ্চার করে না; জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে, সে সম্ভাবনাও জাগায় না। বরং ইংলিশ ভার্সন হওয়ার কারণে সাধারণ শিক্ষাতেও বৈষম্য সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। এটি আবার মাদ্রাসাশিক্ষাতেও ইংলিশ ভার্সনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে; কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ বিভক্তি আর বিভক্তি।

চতুর্ভুজ তাঁর হরিচরিত কাব্যে লিখেছেন, বরেন্দ্র ব্রাহ্মণেরা বিশেষভাবে শ্রুতি, স্মৃতি, পুরাণ, ব্যাকরণ, কাব্যে ব্যুৎপত্তি লাভ করতেন। হরিধর্মদেবের মন্ত্রী ভবদেব ভট্ট অর্থশাস্ত্র, অস্ত্রবেদ, আয়ুর্বেদ, তন্ত্র ও গণিতে পারদর্শী ছিলেন। সংস্কৃত ভাষাও সম্মান ও মর্যাদাসহ শিক্ষা দেওয়া হতো। এই মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞানচর্চা ও জ্ঞান-উৎপাদনে নিয়ত থাকতেন অধ্যাপক ও ছাত্ররা। এই ‘জ্ঞান-উৎপাদন’ অর্থই হলো গবেষণাতে সুফল পাওয়া। ভারত তথা বঙ্গদেশে সে ব্যবস্থা চতুর্থ খ্রিষ্ট শতাব্দেই ছিল। আধুনিক বিশ্বে জার্মান দার্শনিক ইমানুয়েল কান্ট ও ভাষাতাত্ত্বিক ভিলহাল্ম হামবোল্ডটকে বিশ্ববিদ্যালয়-ধারণার জনক বলা হয়। কিন্তু তাঁদের আবির্ভাব অষ্টাদশ শতাব্দীতে। এই মহাত্মাদের আগমনের অন্তত চৌদ্দশ বছর আগে ভারত তথা বঙ্গদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্তিত্ব মেলে; যেখানে আবাসিক ব্যবস্থাসমেত বিদ্যাশিক্ষা ও জ্ঞান-উৎপাদনে রত ছিলেন হাজার হাজার অধ্যাপক ও ছাত্র। কোরিয়া, চায়না, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, পারস্য, তুরস্ক, তিব্বতসহ অনেক দেশ থেকে জ্ঞানের অন্বেষণে এখানে ছাত্রদের পাঠান হতো, অধ্যাপকগণ আসতেন। এই মহাবিহার বা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বাইরে টোল বা পাঠশালা বলে প্রাথমিক শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক ধারণা ছিল। গুরুগৃহ বলেও ছিল শিক্ষালয়। এসবই প্রাচীন ভারতীয় শিক্ষাব্যবস্থার নানা স্তর। নীতিকথার মধ্যে ‘সদা সত্য কথা বলা’, চরিত্রগঠন আর গুরুমুখী জীবনগঠন ছিল প্রাচীন ভারতীয় এই বিদ্যার্জনের মূলকথা। শিক্ষক এখনকার মতো শ্রেণিকক্ষে পঞ্চাশ মিনিটের লেকচার দিয়েই দায়িত্ব শেষ করতেন না কিংবা শুধু মুখে এমন উপদেশ দিয়ে ক্ষান্ত হতেন না: ‘তোমরা কেউ মিথ্যে কথা বলবে না।’ গুরু হয়তো তখন এ কথা বলতেনই না। আসলে গুরু নিজেই কখনো মিথ্যে কথা বলতেন না এবং সেটি পর্যবেক্ষণ করে ছাত্ররাও সত্য ছাড়া মিথ্যে বলতো না। গুরু তাঁর জীবন দিয়ে শেখাতেন; এটি ছিল তাঁদের ব্রত। তাঁরা মনে করতেন: জ্ঞানে ছাত্রের কাছে পরাজিত হলেই তাঁদের গুরুজীবন বা শিক্ষকতাজীবন ধন্য। সংস্কৃতে তাই এমন একটি কথা আছে: ‘সর্বক্ষেত্রে বিজয়মিচ্ছতে সন্তান-শিষ্যাৎ পরাজয়ম্।’

মুসলিম দেশগুলোতে দশম শতকে মক্তব প্রতিষ্ঠা হয়, তারপর উচ্চশিক্ষার্থে প্রতিষ্ঠা পায় মাদ্রাসা। ইবনে সিনার মতে, শিশুদের ৬ বছর থেকে মক্তবে পাঠান দরকার। মক্তবে সাধারণত ভাষা, ব্যাকরণ, চরিত্রগঠন ইত্যাদি শিক্ষা দেওয়া হয়। বিংশ শতাব্দীর আগ-পর্যন্ত মুসলিম দেশগুলোতে মক্তব বেশ জনপ্রিয় ছিল। এখন ভারতীয় টোল-ব্যবস্থা আর মুসলিমদের মক্তব-ব্যবস্থা দুটোই সীমিত হয়ে পড়েছে। তার বদলে প্রাথমিক বিদ্যালয় বা মাদ্রাসায় শিশুদের পাঠান হয়। টোল বা গুরুগৃহ আর মক্তবের ধারণা দুটোর মধ্যে বেশ মিল ছিল। গুরু বা মৌলবির তত্ত্বাবধানে শিশুদের সমর্পণ করে অভিভাবকেরা স্বস্তিতে থাকতেন এবং সেখানে শিশুরা ভাষাজ্ঞান ও চরিত্রগঠনের ভিত্তি অর্জন করতো। বাংলায় ক্ষমতারোহণের মধ্য দিয়ে মুসলিম আগমন ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। সে সময়ের পর বাংলাতেও মক্তব প্রতিষ্ঠা পায়। ফলে বাঙালি হিন্দুদের টোল বা গুরুগৃহ আর মুসলিমদের মক্তবশিক্ষা মোটামুটি একই পদ্ধতিতে জনসমাজে আদরণীয় হয়। এরপর বাংলায় মাদ্রাসাশিক্ষার প্রচলন ঘটে। ইংরেজরা আসবার আগ-পর্যন্ত এই শিক্ষা ধর্মীয় ও নীতি-জ্ঞানের পরিধিতে আবর্তিত হয়েছে। মুসলিমদের মক্তব-মাদ্রাসা শিক্ষা প্রতিষ্ঠার আগে তারা মহাবিহার বা স্থানীয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলো, বিশেষ করে সেখানকার গ্রন্থাগার ও ছাত্রাবাসসহ ধ্বংস করেছিল। যেমন, পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বিশ্ববিদ্যালয় বলে বিবেচিত নালন্দা মহাবিহারকে দ্বাদশ শতাব্দীতে তুর্কিবাহিনী ধ্বংস করে দেয়। এটা অবশ্য ঐতিহাসিকভাবে সত্য যে, ধর্ম প্রসারের জন্য অভিযানগুলোর সময় প্রচুর ঐতিহাসিক গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়। ১২৫৮ সালে বাগদাদ অবরোধকালে বাগদাদের বিখ্যাত বাইতুল হিকমাহ গ্রন্থাগার ধ্বংস হয়; ৬৪০ সালে মুসলিম শক্তি আলেকজান্দ্রিয়া মহাগ্রন্থাগার ধ্বংস করে; ৬৩৮ সালে আরবদের আক্রমণে ধ্বংস হয় ফিলিস্তিনে ক্যাসারিয়া সারিতিমার আধ্যাত্মিক গ্রন্থাগার বলে খ্যাত ‘দ্য থিওলজিক্যাল লাইব্রেরি’। এছাড়া পুথি ও গ্রন্থশালা বারবার আক্রান্ত হয়েছে। বাংলাগ্রন্থ চর্যাপদ যে নেপালে পাওয়া গেল, তার বড়ো কারণ কিন্তু আক্রমণের হাত থেকে বাঁচা। গ্রন্থই যেন শত্রু। পাকিস্তানিরা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের বড়ো বড়ো গ্রন্থাগার আক্রমণ করে নষ্ট করে দিয়েছে। শেষেতো আত্মসমর্পণের মাত্র একদিন আগে বাঙালি প্রথম শ্রেণির বুদ্ধিজীবীদের ঠান্ডা মাথায় হত্যা করে গেল তারা। জ্ঞান ও জ্ঞানীকে মূলশত্রু সবসময় বিবেচনা করেছে এই মতান্ধশক্তি; বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন দেশে।

ইংরেজদের আগমনের পর ইংরেজরা ভারতীয়দের শিক্ষার ব্যাপারে খুব ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। উঠবে কেন? তাদের লক্ষ্য ছিল বাণিজ্য। সেখানে তারা শিক্ষার দায়িত্ব কেন নেবে? হিন্দু ও মুসলিমদেরতো ছিল জনগোষ্ঠী। তাই তারা টোল-পাঠশালা অথবা মক্তব-মাদ্রাসা যে-যতোটুকু পারে, চালু করেছিল। ইংরেজদের খ্রিষ্টধর্ম তখনো ভারতের শিকড় গাড়েনি। মিশনারিরা স্বচেষ্টায় সামান্য কাজ করছিলেন শিক্ষার উপর। পরে ইংরেজ বণিক ও ধর্মপ্রচারকদের মধ্যে সমঝোতা হলে প্রশাসনের পক্ষ থেকে ১৮১৩ সালে ভারতবাসীর শিক্ষাবিস্তারের জন্য এক লক্ষ রুপি বরাদ্দ হয়। সেই থেকে শুরু। ততোদিনে সমঝোতা অনুসারে বুঝে নেওয়া গেছে, খ্রিষ্টধর্ম যতটা প্রচারিত হতে পারে হোক কিন্তু তার সঙ্গে ইংরেজদের স্তাবক একদল ভারতীয় সৃষ্টি করতে হবে এবং তাদের সে শিক্ষাই দিতে হবে যাতে ভারতে তাদের বাণিজ্য করতে অসুবিধা না হয়। ১৮২৩ সালে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, ইংরেজি ভাষায় শিক্ষা দেওয়ার। দুটো কাজ তারা করে: সংস্কৃত ও আরবি গুরুত্বপূর্ণ বইগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ; ইংরেজিতে সরল গ্রন্থ রচনা।

পাকিস্তান আমলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টানো হয়। বিশেষ করে হিন্দু-নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কোপে ফেলা হয়। এটাও পাকিস্তানিরা শিক্ষা-প্রসারের অঙ্গ হিসেবে প্রচার করে; জনগণও তা গ্রহণ করে। মোটকথা, পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলা বা পূর্বপাকিস্তানে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলিত থাকলেও সাধারণ শিক্ষার উপরই সরকারি কোপ নেমে আসে। ব্রিটিশ আমলে যে শিক্ষাব্যবস্থার অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ছিল, সেই শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা যুক্ত করতে সক্ষম হয় পাকিস্তান সরকার।

পাশ্চাত্যধারায় শিক্ষাবিস্তারে অবতীর্ণ হওয়ার আগে ইংরেজদের পদ থেকে ১৮৩৫, ১৮৩৬ ও ১৮৩৮ সালে তিনটি জরিপ করা হয়। তারা দেখে, সে-সময়ের বাংলা ও বিহারে সাধারণ ও পারিবারিকভাবে লক্ষাধিক প্রাথমিক শিক্ষালয় আছে। জনসংখ্যার বিচারে প্রতি ৪০০ মানুষের জন্য একটি শিক্ষালয়। দারুণ ব্যাপার! এখানে শিক্ষকগণ খুবই কম টাকায় (মাসে ৪ থেকে ১০ টাকা) পড়াতেন, কারণ তাঁরা এটাকে ব্রত হিসেবে নিয়েছিলেন। তাঁদের টাকা প্রদান করা হতো সমাজ থেকে দান তুলে অথবা বিত্তবানরা অনুদান দিতেন। এই পদ্ধতিটি উন্নত না করে ইংরেজ আমলে সেটা মেরে ফেলা হলো। অথচ ড. বেল নিজেই ভারত থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে এই পদ্ধতি ইংল্যান্ডে চালু করেছিলেন এবং নাম দিয়েছিলেন ‘মনিটরিয়াল সিস্টেম’। দেশীয় শিক্ষাপদ্ধতির এ ধারাগুলো ধ্বংস করার ক্ষেত্রে যাদের কর্ম ও পরিকল্পনা সক্রিয় কার্যকর ছিল তাদের মধ্যে প্রথম সারিতে ছিলেন লর্ড মেকলে। ‘শিক্ষার উন্নয়ন’ নামে ইংরেজদের পক্ষ থেকে বারবার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বিশেষত ১৮৪৪ ও ১৮৫৩ সালে বাংলাদেশে ১০০টি ভার্নাকুলার বিদ্যালয় এবং কলকাতায় একটি নর্মাল বিদ্যালয় ও আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছিল। এই ধারায় শিক্ষা প্রসারকল্পে ১৮৫৪ সালে উডের ডেসপ্যাচ নামে একটি শিক্ষা-পরিকল্পনা গৃহীত হয়। সে সূত্রে ১৮৫৭ সালে ঢাকায়, ১৮৬৯ সালে চট্টগ্রামে একটি করে নর্মাল স্কুল গড়ে ওঠে। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হয় এবং পরের বছর থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের কাজ শুরু। এটি সারা ভারতের ইংরেজধারার শিক্ষাব্যবস্থার প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়। ইংরেজধারায় প্রাথমিক শিক্ষা ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ভারতীয় প্রচলিত ধারার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো লোপ পেতে থাকে। এর শুরু হয়েছিল মুসলিম শাসনামলে। পারসি ভাষা যখন ভারতের সরকারি ভাষা হিসেবে পরিগণিত হয়, সে-সময় থেকেই একশ্রেণির হিন্দু সন্তানদের সরকারি চাকরি ও সমর্থন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে পারসি শিখিয়েছেন। ধর্মীয়ভাবে বিরোধ হবে এমন ভাবেননি। পারসি শিক্ষিতরা আবার তাদের সন্তানদের ইংরেজি শিখতে পাঠান। কিন্তু মুসলিমদের মক্তব-মাদ্রাসা শিক্ষার ধারা টোল-গুরুগৃহের মতো চরম বিপর্যয়ে পড়ে না। বরং ইংরেজিশিক্ষার ধারাকে পাশ কাটিয়ে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলে। ১৮৭১ সালে কলকাতা মাদ্রাসা (পরে আলিয়া মাদ্রাসা; আজ সেটি আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়) প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মুসলিমদের একটি অংশ সেই ধারায় বিদ্যার্জন করার সুযোগ নেয়। ফলে ইংরেজ শাসনামলে বাংলায় মূলত দুই ধারায় শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হতে দেখা যায়: এক ইংরেজ-প্রবর্তিত সাধারণ শিক্ষাধারা; দুই. ধর্মশিক্ষা ও মাদ্রাসা শিক্ষাধারা। বাংলাদেশে বর্তমানে সংস্কৃত মহাবিদ্যালয় বা আদ্য-মধ্য পঠনপাঠনের হাতে গনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান থাকলেও সেখানে ছাত্রসংখ্যা নগণ্য। ইংরেজ প্রবর্তিত সাধারণ শিক্ষাধারা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের মতো বাংলাতেও মূল শিক্ষাধারা হয়ে ওঠে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হতে থাকে ধীরে ধীরে। অবশ্য ১৯৪৭-এর দেশভাগের পূর্ব পর্যন্ত পূর্ব বাংলার ঢাকায় ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়’ (১৯২১) নামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৪৭-এর দেশভাগের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান অধিভুক্তিকরণের ক্ষমতা লাভ করে। ১৯৪৯ সাল পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষায় ব্রিটিশদের প্রবর্তিত শিক্ষাক্রমই অনুসরণ করা হয়। এরপর এক বিজ্ঞপ্তির (১৯৪৯) মাধ্যমে পরীক্ষার নাম হয় ম্যাট্রিকুলেশন এবং তখন থেকে ১০০ নম্বরের ধর্মীয় ভাষা শিক্ষা চালু হয়। এভাবেই মাধ্যমিক স্তর থেকে পাকিস্তান আমলে ধর্মীয় শিক্ষা অনুপ্রবেশ করে। উল্লেখ্য, প্রথমে ‘ধর্মীয় ভাষা শিক্ষা’ বলা হলেও অচিরেই সেখান থেকে ‘ভাষা’ শব্দটি মিলিয়ে যায়। এ সময় দুই ধরনের বিদ্যালয় দেখা যায়: ইংলিশ ও ভার্নাকুলার। ইংলিশ স্কুলে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক ছিল আর ইংরেজি ভাষা ঐচ্ছিক ছিল ভার্নাকুলার স্কুলে। ১৯৪৯ সালে মৌলানা আকরম খাঁকে প্রধান করে সতেরো সদস্য বিশিষ্ট ‘শিক্ষাব্যবস্থা পুনর্গঠন কমিটি’ সুপারিশ করে, বিদ্যালয়ে উর্দু বা আরবি আবশ্যিক ভাগ হিসেবে পাঠদান করানোর। আর তাঁরা এ-ও প্রস্তাব করেন: ধর্মশিক্ষা মুসলিমদের জন্য আর তার বদলে শারীরিক শিক্ষা অমুসলিমদের জন্য বাধ্যতামূলক করার। এরপর একাধিক শিক্ষা-কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে হয়েছে। এগুলোর কিছু রিপোর্ট দিতে পেরেছে, কিছু পারেনি। আসলে সেসময় ছাত্রদের আন্দোলনের মুখে পাকিস্তানিদের এজেন্ডা বাস্তবায়নের শিক্ষা রিপোর্ট সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে চালু করতে পারেনি। তবে পাকিস্তান সরকার স্কুল-কলেজে সেই কমিশনের ভাবনা মতোই কৌশলে পাঠ্যতালিকা নির্বাচন ও তা পরিচালনা করে। যেমন, ছাত্রদের মৌলিক জ্ঞান আহরণের জন্য ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা; ইসলামি মূল্যবোধ ও পাকিস্তানি আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য কোরান থেকে কিছু সুরা ও আয়াত মুখস্থ করা; কিছু সুরার অর্থ ও আরবিতে লেখার কৌশল রপ্ত করার প্রয়োজনীয়তা; আকাইদ, আখলাক, সিরাত, প্রাথমিক সামায়েল জানার প্রয়োজনীয়তা; পাকিস্তানি আদর্শের অনুযায়ী ইকবাল ও নজরুলের বিশেষ বিশেষ কবিতাপাঠ; মৌলানা ছালির লেখা বই ইত্যাদি সেসময় বিদ্যালয় ও মহাবিদ্যালয়ে পড়ানো হতো। পাকিস্তান আমলে অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের নাম পাল্টানো হয়। বিশেষ করে হিন্দু-নামের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এই কোপে ফেলা হয়। এটাও পাকিস্তানিরা শিক্ষা-প্রসারের অঙ্গ হিসেবে প্রচার করে; জনগণও তা গ্রহণ করে। মোটকথা, পাকিস্তান আমলে পূর্ববাংলা বা পূর্বপাকিস্তানে মাদ্রাসা শিক্ষা প্রচলিত থাকলেও সাধারণ শিক্ষার উপরই সরকারি কোপ নেমে আসে। ব্রিটিশ আমলে যে শিক্ষাব্যবস্থার অন্তত অসাম্প্রদায়িক চরিত্র ছিল, সেই শিক্ষাব্যবস্থায় সাম্প্রদায়িকতা সার্বিকভাবেই যুক্ত করতে সক্ষম হয় পাকিস্তান সরকার। তবে এসময় আরও অন্তত চারটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়। এগুলো হলো রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও ধর্মীয় শিক্ষার প্রভাব ফেলার চেষ্টা চলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোগো পরিবর্তন তার দৃষ্টান্ত কিংবা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের লগোতে আরবি হরফে লেখা তার উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়। ১৯৫২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন লগো পরিবর্তন করে সেখান থেকে স্বস্তিকা চিহ্ন বাদ দেওয়া হয় এবং সেখানে সংযোজিত হয় ধর্মীয়গ্রন্থের চিত্র।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই লোগো ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর সংস্কার করে সেখানে অসাম্প্রদায়িকতার প্রকাশ ঘটানো হয়েছে। ১৯৭০-এ ‘জাহাঙ্গীরনগর মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়’ প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব থাকলেও মুক্তিযুদ্ধের পর যখন সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা আরম্ভ করে তখন নামের ‘মুসলিম’ শব্দটি আর থাকে না। এসবের কারণ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সংঘটিত মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রই ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা। শিক্ষাক্ষেত্রেও তার প্রভাব দেখা যায়। এসময় বিদ্যালয়, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে বিজ্ঞানভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা চলে। কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষাকমিশন গঠন করা হয় এবং সে কমিশনের রিপোর্টও উত্থাপিত হয়েছিল। কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব, বিজ্ঞানভিত্তিক ইহজাগতিক চেতনা গড়ে তোলা, একমুখী শিক্ষাব্যবস্থার দিকে অগ্রসর হওয়া ইত্যাদি ছিল এই শিক্ষাকমিশনের মূলকথা। কিন্তু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার কারণে এই শিক্ষাকমিশনের কোনো সুপারিশই কার্যকর হয়নি। সামরিকবাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত ক্যাডেট কলেজ পূর্বপাকিস্তানে প্রথম স্থাপিত হয় ১৯৫৮ সালে এবং তা চট্টগ্রাম জেলার ফৌজদারহাটে। এরপর ১৯৬৪ সালে ঝিনেদায়, ১৯৬৫ সালে ময়মনসিংহে, ১৯৬৬ সালে রাজশাহীতে ক্যাডেট কলেজ স্থাপন করে শিক্ষাক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি শুরু হয়। এই ধারাবাহিকতার পরে আরও ক্যাডেট কলেজ স্থাপিত হয়েছে। প্রি-ক্যাডেট বলেও একধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর শাসনের সাড়ে তিন বছর এ ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে প্রণোদনা দেওয়া হয়নি। পাকিস্তান আমলে রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল নামে একধরনের আবাসিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়। ১৯৬০ সালে ঢাকায় এই স্কুল চালু হওয়ার পর কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, পাবনা, রংপুর ইত্যাদি জেলার একই ধারায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের পর এই প্রতিষ্ঠানগুলোকে সংসদে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে বিধিবদ্ধ করা হয়। নতুনভাবে ক্যাডেট কলেজ গড়া শুরু হয় ১৯৭৮ সালের পর থেকে। এ সময় রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলগুলোকে ক্যাডেট কলেজে রূপান্তরের প্রক্রিয়া চলে। তবে নানা ধরনের আলোচনা-সমালোচনার কারণে আজ পর্যন্ত ক্যাডেট কলেজের সংখ্যা খুব একটা বাড়েনি। ছেলেদের জন্য ৯টি আর মেয়েদের জন্য ৩টি ক্যাডেট কলেজ এখন বাংলাদেশে চলমান রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের পর এই তিন ধারার শিক্ষাব্যবস্থাই ছিল: সাধারণ শিক্ষা, ক্যাডেট শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা। দাবি উঠেছিল, তিন ধারাকে মিলিয়ে এক ধারার শিক্ষা প্রচলন করার। বঙ্গবন্ধু সেদিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। কারণ তাঁর শিক্ষাদর্শনেও ছিল অসাম্প্রদায়িক ও বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ গড়ার লক্ষ্য, যারা বৃত্তিমূলক শিক্ষা পেয়ে এগিয়ে নিয়ে যাবেন দেশ, সুগবেষণা দিয়ে পথ দেখাবেন।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৬২ সালের ‘রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স’ অনুসারে আবার বেসরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। মূলত ব্যবসার লক্ষ্যে এ বিদ্যালগুলো কিন্ডারগার্ডেন বা অন্য কোনো বাহারি নাম দিয়ে দেশে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা পেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রথম ধসের মুখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ সেই যে বলেছিলেন, শিক্ষার মধ্যে উদ্দেশ্য যদি হয় ব্যবসা বা শুষ্ক কর্তব্য, তাহলে ছাত্র ও শিক্ষক দুপক্ষই হবে ‘হতভাগা’- এখানে ঠিক তেমনটি হলো। বেসরকারি বিদ্যালয়গুলোর দৌরাত্ম্যে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যেখানে বিনা বেতনে পড়ানোর ব্যবস্থা আছে এবং বইগুলো সরকারের পক্ষ থেকে বিনামূল্যে প্রদান করা হয়- সেখানে কিন্ডারগার্টেনে প্রায় হাজার টাকা মাসিক বেতন এবং শিক্ষার্থীদের ওপর বহু দামি বই চাপিয়ে দেওয়ার পরও ছাত্রছাত্রীর অভাব হয় না। সেখানে পড়ার চাপে শৈশব-কৈশোরের আনন্দ মাটি হয়। তারা শুধু বই পড়ে এবং ছোটোবেলা থেকেই প্রতিযোগিতার ইঁদুর দৌঁড়ে নেমে যন্ত্রমানব হয়ে ওঠে। ১৯৬২ সালের বেসরকারি বিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স অনুসারে দেশে এখন প্রায় ১৬০টি ইংরেজি মধ্যম বিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে, যেগুলোর পাঠ্যসূচি সম্পূর্ণভাবে বিদেশের। এসব প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর জন্য শিক্ষার্থী পিছু প্রচুর টাকা ব্যয় করতে হয়। এখানে একজন ছাত্র পড়াতে মাসিক বেতন ও অন্যান্য ফি যতটা লাগে, তা দিয়ে নিম্ন মধ্যবিত্ত একটি পরিবার চলতে পারে। মূলত বিদেশমুখী পরিবারের সন্তানেরা এ প্রতিষ্ঠানগুলোতে ভর্তি হয়; উচ্চশিক্ষা শেষে তারা বিদেশে পাড়ি জমায়। এ প্রতিষ্ঠানগুলোকে ‘ব্রেন-ড্রেন’ বলেও অনেকে অভিহিত করে থাকেন। কারণ স্বদেশের মেধা বিদেশে পাচারের মাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলো ভূমিকা রাখে।

বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৯৬২ সালের ‘রেজিস্ট্রেশন অব প্রাইভেট স্কুল অর্ডিন্যান্স’ অনুসারে আবার বেসরকারি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা শুরু হয়। মূলত ব্যবসার লক্ষ্যে এ বিদ্যালগুলো কিন্ডারগার্ডেন বা অন্য কোনো বাহারি নাম দিয়ে দেশে ব্যাপকভাবে প্রতিষ্ঠা পেলে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রথম ধসের মুখে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ সেই যে বলেছিলেন, শিক্ষার মধ্যে উদ্দেশ্য যদি হয় ব্যবসা বা শুষ্ক কর্তব্য, তাহলে ছাত্র ও শিক্ষক দুপক্ষই হবে ‘হতভাগা’- এখানে ঠিক তেমনটি হলো।

মাদ্রাসা শিক্ষাকে বাংলাদেশে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দেওয়া হয় ১৯৭৮ সালে মাদ্রাসা শিক্ষা অর্ডিন্যান্স জারির মাধ্যমে। এরপর ১৯৭৯ সালে ‘বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড’ গঠিত হয়। এখন প্রতিবছর এই ধারায় ছাত্রছাত্রী বৃদ্ধি পাচ্ছে। মাদ্রাসাশিক্ষার মধ্যে আর একধারা কওমি মাদ্রাসাশিক্ষা। কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তর দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর সমমানের স্বীকৃতি দেওয়া হয়। ‘আল-হাইয়াতুল উলইয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ’- এর অধীনে দাওরায়ে হাদিস (তাকমিল) সনদকে মাস্টার্স সম্মান প্রদান করে জাতীয় সংসদে ২০১৮ সালের সেপ্টেম্বরে আইন পাস হয়। উল্লেখ্য, কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ স্তরকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও সরকারের নজরদারি বা নিয়ন্ত্রণ রাখা হয়নি। সাধারণ মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসার পাঠক্রমেও ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। বিজ্ঞানের সাধারণ পাঠ বা আইনের ইসলামি অংশ সাধারণ মাদ্রাসার পাঠ্যসূচিভুক্ত হলেও কওমি মাদ্রাসায় সেটাও নেই। কওমি মাদ্রাসার ছাত্রছাত্রীদের সেখানকার শিক্ষকগণ তাঁদের রাজনৈতিক মতবাদের পক্ষে সরাসরি মাঠে নামাতে পারেন এবং সেটি তারা করে থাকেন ধর্মীয় ব্যাখ্যা দিয়ে। ফলে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা ধর্মীয় রাজনীতির হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে বলে অনেকে মনে করেন। সাধারণ মাদ্রাসা বা আলিয়া মাদ্রাসার ক্ষেত্রে ব্যাপারটি ছিল কিন্তু এতোটা প্রত্যক্ষ নয়। সেখানে সীমিত পরিসরে হলেও অন্য রাজনৈতিক চিন্তা পোষণের সুযোগ ছিল।

বাংলাদেশে আর এক পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা: ইংলিশ ভার্সন। এটি চিতাবাঘের চামড়ায় মোড়া বেড়ালের মতো! সাধারণ মাধ্যমে যে বইগুলো পড়ায়, সেগুলোই ইংরেজি অনুবাদের মাধ্যমে এখানে পাঠদান করানো হয়। সারাদেশে কয়েকশ বিদ্যালয়ে ইংলিশ ভার্সন আছে এবং দিন-কে-দিন এর চাহিদা বাড়ছে। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এ পদ্ধতি চলছে। মূলত ক্যাডেট কলেজগুলোতে ১৯৯০-এর দশক থেকে ইংলিশ ভার্সন শুরু হয়। শুধু বাংলা ছাড়া সব বিষয় তারা ইংরেজিতে পড়ে। এই পদ্ধতিটি আমলাদের ভালো লেগেছিল। সে অনুসারে একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকে ইংরেজির উপর নির্ভর করে এক নতুন পদ্ধতির শিক্ষাব্যবস্থা চালু হয়। ইংলিশ ভার্সন। ২০১০ সালে টাঙ্গাইলের জেড. এইচ. ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে প্রথম ইংলিশ ভার্সন চালু হয়েছিল। এখন দেশে একই বিদ্যালয়ে, একই শিক্ষক বাংলা ভার্সন ও ইংলিশ ভার্সন পড়াচ্ছেন। এতে ছাত্রছাত্রীদের এক পক্ষের মনে অতিগর্ব ও অন্য পক্ষের মনে হীনম্মন্যতা দেখা দেয়। তারা পরস্পর থেকে মানসিকভাবে দূরত্ব অনুভব করে। কোনো কোনো বিদ্যালয় অবশ্য বাংলা ভার্সন বন্ধ করে সম্পূর্ণ ইংরেজি ভার্সনে চলে যাচ্ছে। এদিকে ১৯৬৭ সালে কারিগরি বোর্ডের সূচনা হলেও এই ধারার শিক্ষা কখনোই বিপুলভাবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পায়নি। ফলে অনেকটা অনালোচিত ও অনাদরে থেকে গেছে এই শিক্ষাধারা। আজও প্রয়োজনীয় গুরুত্ব না পাওয়ায় বলা চলে রুগ্ন অবস্থায় আছে এই শিক্ষাধারাটি।

বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যে পদ্ধতিসমূহ বিরাজমান তার হিসেব করলে আজ বহুধারার উপস্থিতি লক্ষ করা যাবে। যেমন,
১. সাধারণ শিক্ষা : ক. বাংলা ভার্সন ও খ. ইংলিশ ভার্সন;
২. মাদ্রাসা শিক্ষা : ক. আলিয়া ধারা ও খ. কওমি ধারা;
৩. ক্যাডেট শিক্ষাধারা;
৪. ইংরেজি-মাধ্যম শিক্ষা;
৫. কারিগরিশিক্ষা

এই পাঁচ ধারায় মূলত সাতভাবে শিক্ষা সম্প্রসারণ বা বিভক্তি চলছে সারাদেশে। ধারাগুলোর মধ্যে আছে আর্থিক খরচেরও তারতম্য। যেমন, একজন ছাত্র ইংলিশ মিডিয়ামের ছাত্রের পড়ার খরচ সবচেয়ে বেশি এবং তার লেখাপড়াও বিদেশি পাঠক্রম বা সিলেবাস অনুসারে। এরপর ক্যাডেট শিক্ষাধারায় যে পড়ছে তার মূল্য। যদিও তার লেখাপড়ার খরচ আকাশচুম্বী নয়, কিন্তু সরকারি বিশেষ পৃষ্ঠপোষকতা যেহেতু ক্যাডেট কলেজগুলো পেয়ে থাকে, সেহেতু সেই বরাদ্দ তার শিক্ষাতেও যুক্ত হয়। এরপর সাধারণ শিক্ষার ইংলিশ ভার্সন। একই পড়া বাংলার বদলে ইংরেজি ভাষায় পড়ার কারণে তাকে প্রাইভেট টিউশন থেকে অতিরিক্ত কোচিং সবই নিয়ে হয়। এভাবে শিক্ষার মোটামুটি একটি স্তর তৈরি হয়ে গেছে, যেখানে মূলত আর্থিকভাবে ধনীরা সম্পৃক্ত। অবশ্য ক্যাডেট কলেজে ভর্তির জন্য যে প্রস্তুতি ও কোচিং করতে হয় তা সাধারণ মানুষের আয়ের সীমা অনুসারে তাদের জন্য কষ্টকর বটে। ফলে মোটামুটি আর্থিক স্বাচ্ছল্য না থাকলে এই স্তরে পৌঁছা যায় না। অন্য স্তরটি তৈরি হয়েছে বাংলা ভার্সনের সাধারণ শিক্ষা ; আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসাশিক্ষা ; কারিগরি শিক্ষাধারার সমন্বয়ে। মাদ্রাসা ও কারিগরিতে পড়ানোর জন্য অভিভাবকের খরচ খুব বেশি নয়। বাংলা ভার্সনের সাধারণ শিক্ষায় এখনো আগ্রহী আছেন অনেক অভিভাবক এবং তারা সন্তানদের সেই ধারাতেই ভর্তি করে দিচ্ছেন। কিন্তু ধীরে ধীরে এই ধারা থেকে ইংলিশ ভার্সনে সন্তান ভর্তির আগ্রহ বেশি লক্ষ করা যাচ্ছে। কারণ ইংলিশ ভার্সন থেকে পাস করলে চাকরি ও প্রতিষ্ঠা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। স্বল্প আয়ের মানুষেরা মাদ্রাসায় সন্তান পাঠান। এতে ধর্মীয় ‘ফজিলত’ আছে আর প্রায় বিনাপয়সায় লেখাপড়া করানোর সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। আর সনদপত্রের সরকারিমূল্য ‘সমান’ বলে স্বীকৃতি পাওয়ায় মানুষের মাদ্রাসা শিক্ষার প্রতি আগ্রহ বেশি লক্ষ করা যায়।

উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রথম প্রতিষ্ঠান ধরলে সেধারার সরকারি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি চিকিৎসা, প্রকৌশল এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় পরে অনেকই স্থাপিত হয়েছে। এগুলোর সংখ্যা ত্রিশের বেশি। ২০১৭ সালে সরকার-প্রধান ঘোষণা করেন, প্রতিটি জেলায় অন্তত একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হবে। সে হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ১৯৯২ সালে জাতীয় সংসদে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পাস হওয়ায় এখন বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। কিন্তু প্রশ্ন উঠেছে শিক্ষার মান নিয়ে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-নিয়োগের নীতিমালা ঠিকভাবে না থাকায় যেনতেনভাবে সেখানে পাঠদান ও সনদপত্র প্রদান করা হচ্ছে। আর্থিক লাভের দিকে তাকিয়ে অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ই যান্ত্রিকভাবে সেমিস্টার পরিচালনা করছে। বেসরকারি মেডিক্যাল কলেজ সম্পর্কেও এই আর্থিক লাভালাভের কথা শোনা যায়। মফস্বলের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নিন্মমানের লেখাপড়া এবং শিক্ষকদের শুধু পদোন্নতির দিকে দৃষ্টিপাতের সংবাদ প্রায়ই পত্রিকায় আসে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ও সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুত কতটুকু, সে প্রশ্ন উঠেছে। কারণ,  বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ওয়ার্ল্ড রেঙ্কিঙে’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থান থাকে না। এদিকে ১৯৯২ সালে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে কলেজসমূহে স্নাতক (স.) পঠনপাঠনের সমন্বয় করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। নামে বিশ্ববিদ্যালয় হলেও এটি মূলত বোর্ডের মতো শুধু পরীক্ষার সমন্বয় করে থাকে। এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেনোজলের মতো সনদপত্র প্রদান করা হচ্ছে। এর আগে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ নামে এক ধরনের অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই এই অদ্ভুত ধারা বন্ধ হয়। মোটকথা, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় চলছে এমন এক অবস্থা, যার সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সমন্বয় করা যায়নি। যেমন, ইংলিশ মিডিয়ামে যারা লেখাপড়া করে ‘ও’ লেভেল শেষ করে, তারা কোথায় পড়বে, তার স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। আবার কারিগরি শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা নিতে হলেও ঠিক প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।

এর আগে ‘বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ’ নামে এক ধরনের অদ্ভুত প্রতিষ্ঠান ছিল বাংলাদেশে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই এই অদ্ভুত ধারা বন্ধ হয়। মোটকথা, বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায় চলছে এমন এক অবস্থা, যার সঙ্গে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ের লেখাপড়ার সমন্বয় করা যায়নি। যেমন, ইংলিশ মিডিয়ামে যারা লেখাপড়া করে ‘ও’ লেভেল শেষ করে, তারা কোথায় পড়বে, তার স্পষ্ট নির্দেশনা নেই। আবার কারিগরি শিক্ষায় উচ্চশিক্ষা নিতে হলেও ঠিক প্রতিষ্ঠান খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে।

বর্তমানে শিক্ষার এই যখন অবস্থা, তাহলে ভবিষ্যতের শিক্ষা কোন পথে? ইতিহাস পর্যালোচনা করে এটাই প্রতীয়মান হয়, শিক্ষার ধারা ক্রমান্বয়ে আপসের চোরাবালিতে গিয়ে পড়েছে। শুধু মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শিক্ষার বহুমুখী ও এলোমেলো বিস্তারকে রোধ করতে চেয়ে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিয়েছিলেন এবং কুদরাত-ই-খুদা শিক্ষাকমিশনের মাধ্যমে বিরাট পরিবর্তন সাধন করতে চেয়েছিলেন। তিনি ৩৬ হাজারের বেশি বিদ্যালয়কে জাতীয়করণের মাধ্যমে শিক্ষাকে সর্বজনীন রূপ দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৭৫-এর আগস্ট সেই স্বপ্ন বাস্তবায়িত হতে দেয়নি। ফলে ব্রিটিশ শাসনামল থেকে দেশে অদ্যাবধি শিক্ষার যে বিভিন্ন ধারা সৃষ্টি হয়েছে তা কোনো বিশেষ আশার সঞ্চার করে না; জাতি ঐক্যবদ্ধ হবে, সে সম্ভাবনাও জাগায় না। বরং ইংলিশ ভার্সন হওয়ার কারণে সাধারণ শিক্ষাতেও বৈষম্য সৃষ্টি হতে শুরু করেছে। এটি আবার মাদ্রাসাশিক্ষাতেও ইংলিশ ভার্সনের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে; কারিগরি শিক্ষার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। অর্থাৎ বিভক্তি আর বিভক্তি। ভবিষ্যতের শিক্ষার মূলমন্ত্র হওয়ার দরকার একতা এবং ঐক্যবদ্ধতা। প্রথমত জাতি হিসেবে বাঙালি এমন শিক্ষা নেবে যা সবার মধ্যে একতা তৈরি করবে এবং বিজ্ঞানমনস্কতার মাধ্যমে সবাইকে আধুনিক যুগের সঙ্গে মেলাবে; দ্বিতীয়ত বৈশ্বিক এই পরিস্থিতিতে স্বদেশের জ্ঞান যূথবদ্ধভাবে বিশ্বদরবারে তুলে ধরবে। কিন্তু সে সম্ভাবনা ক্ষীণ। কেননা, মাতৃভাষা বাংলাকেন্দ্রিক লেখাপড়া ক্রমেই সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। বাঙালির জাতীয়তাবাদী মৌলচেতনা নিহিত আছে তার ভাষাতে। মূলত বাংলা ভাষার রাষ্ট্র বাংলাদেশ। এই বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় বাংলা ভাষা উপেক্ষিত হয়ে আছে, এটাই পরিতাপের বিষয়। উপরে যে প্রথম স্তরটির কথা উল্লেখ করা হলো- ইংলিশ মিডিয়াম, ক্যাডেট কলেজ, ইংলিশ ভার্সন সাধারণ শিক্ষা-  এরাই মূলত সমাজের ওপরের তল নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রস্তুত। তারা সেটা করেও। সেখান থেকে তাদের নিম্নবর্তী তলকে অবশ্যই মনে হবে অপাংক্তেয়। এই বিভাজনটি দূর করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতের শিক্ষাপরিকল্পনায় এই বিভাজনটি যদি দূর করা না যায়, যদি বাংলা ভাষাকে যথাযথ মর্যাদা দিয়ে শিক্ষাক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতের শিক্ষা একবিংশ শতাব্দীর চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ঠিকভাবে মাটি পাবে না। আর স্বভাষার মাটি না-পাওয়া শিক্ষা-শিকড় বাহারি হতে পারে কিন্তু তা ভবিষ্যতের ঝড়-বাদলে কতোটুকু টিকে থাকবে, ভেবে দেখা দরকার। 

লেখক: অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

সর্বশেষ
জনপ্রিয়