ঢাকা, শুক্রবার   ২৯ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

শেষ বিকেলের রংধনু

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৩১, ১৯ মে ২০২১  

ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

কু-উ-উ-। কু-উ-উ-। আশপাশের কোনো গাছ থেকে ডাকছে কোকিলটা। গ্রাম নয়। শহরের বাসার ছাদ থেকেই শোনা যাচ্ছে ডাকটি। ছাদের কার্নিশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আমিন তাকায় দূরে। ওখানে অনেক গাছ। ওদিক থেকেই ডাকছে কোকিলটা। আমিন নকল করে তার সুর। সে-ও ডাকে কু-উ-উ--। কু-উ-উ--। 

সূর্যটা ঘরের উপর গড়িয়ে আরাম করে হেলান দেয় পশ্চিমে। তখন ঘর থেকে বেরিয়ে আসে বিলকিস। আমিন বিলকিসের ছোটোভাই। রান্নাবাটি খেলার আসরে থাকে তার পুতুল। বিনীতা, রীতা, মিতা। কিন্তু আজকের দিন আলাদা। এখানে অনেক মজা হবে আজ। বিলকিস তার আয়োজনে ব্যস্ত।
-আপু, তুই কোকিল দেখেছিস কখনো? মুখ ঘুরিয়ে বোনের কাছে জানতে চায় আমিন। চাটাই পেতে বিলকিস বসেছে তার পুতুল নিয়ে। 
- একবার দেখেছিলাম। অনেক আগে। ইশকুলের পেছনের জামরুল গাছে। বসে ডাকছিলো। পুতুল বিনীতাকে সাজাচ্ছে বিলকিস। বিনীতার জন্মদিন আজ। চারতলা, তিনতলা, পাঁচতলার বন্ধুদের দাওয়াত দেয়া হয়েছে। রান্না হবে মাছ, মাংস, ডিম, সবজি আরো কতো নাশতা। ছোট্ট ছোট্ট পাতিল সাজিয়ে তারই তৈরি চলছে। কার্নিশের পাশ থেকে সরে আমিন এসে বসে বোনের পাশে।
- ইস! ইশকুল খোলা থাকতো! আমিও তাহলে দেখতে পেতাম।
কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাইবোনে টুকটাক কথা।
- বাড়ি গেলে খুঁজে বের করবো। তখন দেখবি।
- কখন বাড়ি যাবো? 
- আরে বোকা! ঈদ আসছে না! তখন যাবো আর কি।
-বাবা বলেছে? ইস! তাহলে তো খুব মজা হবে। আনন্দ ভরা আমিনের কথায়। 
- তোর মনে আছে আপু, সেবার আমার বড়শিতে একটি পুঁটিমাছ উঠেছিলো? পুকুরে যখন তুই আর আমি মাছ ধরছিলাম?
-খুউব মনে আছে! কী ব্যথা পেয়েছিলি! যখন মাছ ছাড়াতে গিয়ে বড়শি গেঁথে গেলো হাতে! বাবা এসে বড়শিটা বের করলো। উফ! রক্তে ভেসে গিয়েছিলো তোর আঙুল, হাত। আমিনের সঙ্গে কথা বললেও, হাত দুটো ব্যস্ত বিলকিসের। বিনীতার পাশে রীতা, মিতাকে বসিয়ে দেয় বিলকিস। 
- না বাবা! এবার আমি আর বড়শিতে হাত লাগাবো না। আপু, তুই আমাকে কোকিল দেখাবি? 
- আগে বাড়ি যাই। ডাক শুনলে খুঁজে দেখবো।
- কোকিলটাকে ধরে আমরা পোষ মানাবো। কথা শেখাবো। গান শেখাবো। আমার আর তোর নাম শেখাবো। কেমন?
- দূর বোকা! কোকিল কথা বলে নাকি! সুন্দর করে ডাকতে পারে শুধু। 
-আমাদের বাদ দিয়ে কেক কেটে ফেলেছো! ছাদে উঠে এসেছে মিম্বর, মুনা, বিলকিস, অসমি, মিররাত, ইবরাত। সঙ্গে নিয়ে এসেছে যার যার পুতুল। বিনীতার পাশে বসে যায় রীনা, রিয়া, সম্পন্না, এলিজা, আয়শা। বিলকিসের দাওয়াত করা মেহমান এসে পড়েছে। 
- না। না। এই দেখো। 
মাটির তৈরি কেকটি দেখায় বিলকিস। তোমরা না এলে কী কাটবো! এখানে  বসো সবাই।
সবাই বসে পড়ে চাটাইয়ে। ছাদ বাগান আজ আনন্দে মেতেছে। বাতাস মজা পেয়ে লুটোপুটি খায় ওদের চুলে। অলকানন্দা হেসে ওঠে খিলখিল করে। বিকেলের সোনালি রোদে অপরাজিতা আরো নীল হয়। তার চোখ উজ্জ্বল হয় আরো। পাথরকুচির বেগুনি ফুলের থোকা কানাকানি করছে। কা কা করে কাক এসে বসে ছাদের রেলিংয়ে। কবুতর পাশ দিয়ে উড়ে যায় কোনো শব্দ না করে। 
-দেখো! কাক, কবুতরও এসেছে বিনীতার জন্মদিন দেখতে! খুব মজা হবে আজ। তাই না? রেলিংয়ের দিকে দেখিয়ে মিম্বর বলে। সবাই হেসে ওঠে ওর কথা শুনে। 
- সবাই এসে পড়েছি। চলো এবার কেক কাটি। মুনা তাড়া দেয়।
- চলো। চলো। দেরি সইছে না আসমির।
- হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। হ্যাপি বার্থডে টু বিনীতা। হ্যাপি বার্থডে টু ইউ। 
ওরা কেউ জানে না। ছাদবাগানের সঙ্গীরাও ওদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে গাইছে। নদীর মতো কলকল করছে ছাদ। 
-মাছ, মাংস, ডিম, নাশতার প্লেট নিয়ে বসলো সবাই।
- ভাই, তোমার রান্না খুউব মজা হয়েছে।
সবার মুখে প্রসংশা। বিলকিসের হাসিতে ঝিলিক দেয় খুশি। বিকেলের মতো মায়া সেই হাসিতে। গল্প-হাসির মধ্যেই কোকিলটি আবার ডাকে, কু-উ-উ--। আমিনও নাকি সুরে ডাকে কু-উ-উ। ঝিলমিল হাসি উপচে পড়ে ছাদ বেয়ে। 
- জানো, ঈদে আমরা বাড়ি যাবো।কোকিল ধরবো। এখানে এনে দেখাবো তোমাদের। 
- কোকিল অনেক চালাক পাখি। সে তো লুকিয়ে থাকে। তুমি ধরবে কেমন করে! মুনার কথায় একটু হতাশ হয় আমিন। 
-জানো, কী দুষ্টু পাখি কোকিল? সে অন্য পাখির বাসায় ডিম পাড়ে। দেখে দেখে এমন বাসা বের করবে যেখানে পাখির ডিম আছে। নিজের ডিমটা রেখে একটা ডিম ফেলে দেয় বাসা থেকে। যাতে অন্য পাখি যেনো বুঝতে না পারে তার একটি ডিম নেই।
- ও মা! কী দুষ্টু! আমিন অবাক হয়ে বলে। মন দিয়ে শোনে মিম্বরের কথা। 
কু-উ-উ- কোকিলটি ডেকে ওঠে আবার। কুটকুট করে হেসে দেয় আমিন। বলে,
- মিম্বর আপু, কোকিল তোমাকে বকা দিচ্ছে। আমরা ওকে দুষ্টু বলেছি, ও শুনেছে। তবুও বাড়ি গেলে আমি ওকে ঠি--ক খুঁজে বের করবো। 
সূর্যটা টুপ করে কবে ডুব দিয়েছে। ঘরে ফিরতে হবে সবার। বিনীতা, রীতা, মিতা, সম্পন্না, এলিজা, আয়শা সবাই ঢুকে পড়েছে যার যার বাক্সে। পুতুল খেলার বিকেল শেষ হয়। সবাই ফিরে যায় যার যার ঘরে।
-এই যে তোমাদের ঈদের জামা-কাপড়।
- কী সুন্দর জামা! জরি চুমকির ঝলমলে কাজ করা ফ্রক। বিলকিসের আনন্দ ধরে না। 
- আমার পাঞ্জাবি আরো সুন্দর। এমব্রয়ডারি কাজ করা পাঞ্জাবি পেয়ে খুশিতে চকচক করছে আমিনের চোখ। 
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ওরা দেখছে নতুন জামাগুলো। ঈদ আসার আগেই ঘরে ঈদের আনন্দ। 
- যাও। এবার দুজনেই ভালো করে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে এসো। বাবার কথামতো দুজনেই চললো হাত ধুতে।  
- সালেহা, এবার মনে হয় বাড়ি যাওয়া হবে না। রমিজ বললো। বিলকিস, আমিনও শুনতে পেলো বাবার কথা। 
বিকেলের স্বপ্নগুলো যেনো সূর্যের মতো ডুবে গেলো। এক মুহূর্তে। বাবা গাড়ি চালায়। বাবার কাছে সব খবর আছে। বিলকিস তাকায় আমিনের দিকে। তার চোখ ছলছল করছে। 
- তাহলে কি ঈদে আমরা বাড়ি যাবোনা? বাবা? 
- জানি না রে বাবা। হাসপাতালে জায়গা নেই। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ করোনা আক্রান্ত হচ্ছে। হবে না কেনো? কেউ ঠিক মতো মাস্ক পরে? কেউ কানে ঝুলিয়ে রাখে। কেউ নামিয়ে রাখে থুতনির নিচে। কেউ নিয়ম মানছে? সে জন্যেই তো আবার লকডাউন হচ্ছে। সবকিছু বন্ধ। বাবার রাগ দেখে চুপ হয়ে যায় আমিন। কিছু বলেনা বিলকিসও। ঘরটা কেমন নিরব হয়ে যায়। ঘুমোতে গিয়ে আজ চোখ বন্ধ হয়না আমিনের। 
- আপু, এবারও আমরা বাড়ি যেতে পারবোনা? আমার আর কোকিল দেখা হবে না? এভাবে ছাদে খেলতে আর ভালো লাগে না।
- বাবা তো বলেছে যাওয়া যাবে না। দেখিসনি বাবার মনও ভালো নেই। মা-ও কেমন চুপ করে আছে?
- এই করোনা কতদিনে যাবে আপু? আমরা আবার কখন ইচ্ছেমতো ঘুরাঘুরি করতে পারবো? ইশকুলে যেতে পারবো? মজা করে ঈদ করতে পারবো? 
-আমরা সব নিয়ম-কানুন মেনে চললে স-ব ঠিক হয়ে যাবে ভাই। এখন তো ভ্যাক্সিনও বেরিয়েছে! তুই ঘুমা এখন। 
ভাইকে সান্ত্বনা দিলেও বিলকিসের মনও ছুটে যায় সাতফুল গ্রামে। ঘুরে বেড়ায় গ্রামের পুকুর পাড়ে। ধানের সবুজ জমিতে। উঠোনের নরোম ঘাসে। ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত বিলকিস। ঘুম পরি এসে বসে চোখের পাতায়। 
পরদিন আবার বসে পুতুল নিয়ে। ছাদবাগানের গাছগুলো আজ দুলছে না। ওরাও কেমন বিষন্ন। বিলকিস আর আমিনের মতো। একদিন, দুদিন করে সময় হাঁটে। বিষ্যুদবার বাবা একটু তাড়াতাড়িই ফিরলো। 
- বিলকিস, আমিন এদিকে এসো। এ-সময় বাবা খুব দরকার না হলে আসে না। খেলা রেখে তাড়াতাড়ি দুজন এসে দাঁড়ালো বাবার কাছে।
- সাতফুল যাবে? এই দেখো বাসের টিকিট নিয়ে এসেছি! বাবার মুখে আনন্দের হাসি।
সালেহা, কাল সকালের বাস। ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে নাও। বিকেলটা হঠাত করে যেনো রঙধনুর মতো রঙিন হয়ে গেলো। দৌড়ে বিলকিস, আমিন চলে গেলো ঘরের মধ্যে। মায়ের সঙ্গে ওরাও ব্যাগ গুছাবে। নিতে হবে বিনীতা, রিতা, মিতাকেও। বাতাসের ডানায় বসে আমিন ঘুরতে চলে গেছে সাতফুল গ্রামে। সেখানে কোথাও কোকিল ডাকছে- কু-উ-উ --।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়