ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ২৮ মার্চ ২০২৪ ||  চৈত্র ১৪ ১৪৩০

হাদিসের আলোকে জিনের চুরি ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায়

ধর্ম ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৬:৫১, ৮ জানুয়ারি ২০২২  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

জিন হলো আল্লাহর সৃষ্ট একটি জাতি। এক অদৃশ্য জগতের নাম। যাদের সম্পর্কে মানুষের সব বিস্তারিত কিছু জানা সম্ভব না হলেও তাদের সৃষ্টি, অবস্থান এবং ভালো-মন্দ কর্মকাণ্ডের বিষয়গুলো সুনিশ্চিত সত্য। জিনের অস্তিত্ব ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কোরআনের একাধিক আয়াতে সুস্পষ্ট কিছু দিকনির্দেশনাও রয়েছে। আবার ‘জিন’ নামে একটি সুরাও রয়েছে। কিন্তু প্রশ্ন হলো- জিনেরা কি মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে? এ থেকে বাঁচার উপায়ই বা কি?

জিনেরা মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করতে পারে। এ প্রসঙ্গে হাদিসের সুস্পষ্ট প্রমাণ যেমন রয়েছে আবার আলেমরাও এ ব্যাপারে বলেছেন, তারা মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করতে পারে। কারণ তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই ধরনের জিনই আছে। সুতরাং তাদের মধ্যে যারা খারাপ জিন (শয়তান) তারা মানুষের ক্ষয়-ক্ষতি করার সব ধরনের পন্থাই অবলম্বন করে থাকে।

জিন জাতির সৃষ্টি ও তাদের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা কোরআনের একাধিক আয়াতে ঘোষণা করেন-
১. وَ مَا خَلَقۡتُ الۡجِنَّ وَ الۡاِنۡسَ اِلَّا لِیَعۡبُدُوۡنِ
‘আর আমি সৃষ্টি করেছি জিন ও মানুষকে কেবল এ জন্য যে, তারা আমারই ইবাদত করবে।’ (সুরা জারিয়াত : আয়াত ৫৬)
এ আয়াত প্রমাণ করে যে, মানুষের মতো জিনরাও আল্লাহর ইবাদত করবে এটা আল্লাহর চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত। আবার মানুষের মতো তাদের কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে ইচ্ছা ও ইখতিয়ারের স্বাধীনতাও দিয়েছেন আল্লাহ। যে কারণে তারা মানুষের মতো ভালো কাজের পাশাপাশি মন্দ কাজও করতে পারে। মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করতে পারে- এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়।

২. قُلۡ اُوۡحِیَ اِلَیَّ اَنَّهُ اسۡتَمَعَ نَفَرٌ مِّنَ الۡجِنِّ فَقَالُوۡۤا اِنَّا سَمِعۡنَا قُرۡاٰنًا عَجَبًا یَّهۡدِیۡۤ اِلَی الرُّشۡدِ فَاٰمَنَّا بِهٖ ؕ وَ لَنۡ نُّشۡرِکَ بِرَبِّنَاۤ اَحَدًا
‘(হে রাসুল! আপনি) বলুন, আমার প্রতি অতি এসেছে যে, জিনদের একটি দল মনোযোগ সহকারে শ্রবণ করে বলেছে, ‘আমরা তো এক বিস্ময়কর কুরআন শ্রবণ করেছি। যা সঠিক পথ-নির্দেশ করে; ফলে আমরা তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছি। আর আমরা কখনো আমাদের প্রতিপালকের কোনো শরিক স্থাপন করব না।’ (সুরা জিন : আয়াত ১-২)

৩. মানুষ ও জিন আল্লাহর বিধানের লঙ্ঘন করবে অন্যায় কাজে জড়িত হওয়া বিষয়টিও কোরআনে এভাবে ওঠে এসেছে-
وَّ اَنَّا ظَنَنَّاۤ اَنۡ لَّنۡ تَقُوۡلَ الۡاِنۡسُ وَ الۡجِنُّ عَلَی اللّٰهِ کَذِبًا
‘অথচ আমরা মনে করতাম যে, মানুষ এবং জ্বিন আল্লাহ সম্বন্ধে কখনো মিথ্যা আরোপ করবে না।’ (সুরা জিন : আয়াত ৫)

৪. প্রমাণ-
وَّ اَنَّهٗ کَانَ رِجَالٌ مِّنَ الۡاِنۡسِ یَعُوۡذُوۡنَ بِرِجَالٍ مِّنَ الۡجِنِّ فَزَادُوۡهُمۡ رَهَقًا
‘আর কিছু মানুষ কিছু কিছু জিনদের কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করতো; ফলে তারা জিনদের অহংকার বাড়িয়ে দিতো।’ (সুরা জিন : আয়াত ৬)

জিন কর্তৃক মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করা প্রসঙ্গে আলেমগণ বলেন যে, তারা মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করতে পারে। কারণ তাদের মধ্যে ভালো-মন্দ দুই ধরণের জিন আছে। সুতরাং তাদের মধ্যে খারাপ জিন (শয়তান) গুলো মানুষের ক্ষয়ক্ষতি করার সব পন্থা অবলম্বন করে থাকে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন-
৫. وَأَنَّا مِنَّا الصَّالِحُونَ وَمِنَّا دُونَ ذَٰلِكَ ۖ كُنَّا طَرَائِقَ قِدَدًا ‎
‘(জিনরা বলে) আমাদের কেউ কেউ সৎকর্ম পরায়ণ এবং কেউ কেউ এরূপ নয়। আমরা ছিলাম বিভিন্ন পথে বিভক্ত।’ (সুরা জিন : আয়াত ১১)

কেন মানুষের সম্পদ চুরি করে জিন?
খারাপ জিন বা শয়তানরা মানুষকে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করে এবং বিভিন্নভাবে তাদেরকে বিরক্ত করে। প্রকৃতপক্ষে তারা বনি আদমের ক্ষতি করার এমন কোনও পথ ও পদ্ধতি বাকি রাখে না যা তারা করে না। কারণ তারা তাদের পূর্ব ঘোষিত প্রকাশ্য শত্রু।

কখনো কখনো খারাপ জিনেরা জিনবশকারী (গনক-জাদুকর) নামক দাজ্জালদের নির্দেশে মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করে আবার কখনো মানুষের ক্ষতি সাধন করে বা তাদরকে কষ্ট দেওয়ার উদ্দেশ্যে এমনটি করে। এতে জিনদের নিজেদের কোনও লাভ থাকুক বা না থাকুক। এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন-
إن للجن والشياطين لذة في الشر والفتن، يحبون ذلك وإن لم يكن فيه منفعة (الفُرقان بينَ الحقِّ والباطلِ)
‘জিন-শয়তানরা অনিষ্ট সাধন এবং ফেতনা সৃষ্টি করে মজা পায়। তারা এটা করতে পছন্দ করে। যদিও এতে তাদের কোনো উপকার না থাকে।’ (আল ফুরকানু বাইনাল হাক্বি ওয়াল বাতিল)

জিনদের চুরির পক্ষে দলিল
জিন কর্তৃক মানুষের অর্থ-সম্পদ চুরি করার পক্ষে আলেমগণ হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহুর একটি হাদিস তুলে ধরেন। যখন তিনি যাকাতের খাদ্যদ্রব্য পাহারায় নিয়োজিত ছিলেন; তখন শয়তান কর্তৃক তা চুরি করার লম্বা এ ঘটনাটি হাদিসের বিখ্যাত গ্রন্থ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে।

জিনের ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায়
জিনের চুরি ও ক্ষয়ক্ষতি থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে হাদিসের একাধিক বর্ণনা রয়েছে। তাতে ওঠে এসেছে-
১. আল্লাহর কাছে আশ্রয় প্রার্থনা করা-
أَعُوْذُ بِاللهِ مِنَ الشَّيْطَانِ الرَّجِيْمِ، مِنْ هَمْزِهِ وَنَفْخِهِ وَنَفْثِهِ
উচ্চারণ : ‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শাইত্বানির রাঝিম; মিনহামযিহি ওয়া নাফখিহি ওয়া নাফছিহি।’
অর্থ : ‘আমি আল্লাহর কাছে বিতাড়িত শয়তান থেকে তার প্ররোচনা ও ফুৎকার থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করছি।’

২. জিন-শয়তান থেকে বেঁচে থাকার মাসনুন আমল
বাড়িতে প্রবেশ করতে দোয়া পড়া। তাহলে শয়তান বাড়িতে প্রবেশ করতে পারবে না আর ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ পড়ে ঘরের মূল্যবান মালামাল সিন্দুক বা সংরক্ষিত কোনও স্থানে রেখে তার মুখ বন্ধ করা। তাহলে শয়তান বন্ধ মুখ খুলে তা চুরি করতে পারবে না। হাদিসে এসেছে-
إِذَا دَخَلَ الرَّجُلُ بَيْتَهُ، فَذَكَرَ اللَّهَ عِنْدَ دُخُولِهِ وَعِنْدَ طَعَامِهِ، قالَ الشَّيْطَانُ: لا مَبِيتَ لَكُمْ، وَلَا عَشَاءَ
‘যখন কোনো ব্যক্তি তার ঘরে প্রবেশের সময় ও খাবারের সময় আল্লাহকে স্মরণ করে তখন শয়তান (নিজ সঙ্গীদেরকে) বলে, তোমাদের রাত কাটানোর কোনো জায়গা নেই; তোমাদের রাতের কোনো খাবারও নেই।’ (মুসলিম)

জিন ও শয়তান থেকে হেফাজত থাকতে রাতের কিছু করণীয়ও রয়েছে। হাদিসে পাকে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন এভাবে-
غَطُّوا الإِنَاءَ وَأَوْكُوا السِّقَاءَ وَأَغْلِقُوا الْبَابَ وَأَطْفِئُوا السِّرَاجَ فَإِنَّ الشَّيْطَانَ لاَ يَحُلُّ سِقَاءً وَلاَ يَفْتَحُ بَابًا وَلاَ يَكْشِفُ إِنَاءً فَإِنْ لَمْ يَجِدْ أَحَدُكُمْ إِلاَّ أَنْ يَعْرُضَ عَلَى إِنَائِهِ عُودًا وَيَذْكُرَ اسْمَ اللَّهِ فَلْيَفْعَلْ فَإِنَّ الْفُوَيْسِقَةَ تُضْرِمُ عَلَى أَهْلِ الْبَيْتِ بَيْتَهُمْ‏
> তোমরা (রাতের বেলা) পাত্রগুলো ঢেকে দাও;
> মশকগুলো (চামড়ার তৈরি পানি রাখার পাত্র বিশেষ) এর মুখ আটকিয়ে দাও;
> ঘরের দরজা বন্ধ করে দাও এবং
> চেরাগ (আলো) নিভিয়ে দাও।
কারণ, শয়তান মশকের বাঁধন খুলতে পারে না, দরজা খুলতে পারে না এবং পাত্রও উন্মুক্ত করতে পারে না। তবে তোমাদের কেউ পাত্র ঢাকার জন্য একটা কাঠি ছাড়া অন্য কিছু না পেলে যেন তাই রাখে এবং সাথে আল্লাহর নাম উচ্চারণ করে- ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম’ পড়ে নেয়। কেননা ইঁদুর চেরাগের আগুন থেকে লোক-জনসহ বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়।’ (মুসলিম)

সুতরাং রাতে পাত্র আচ্ছাদিত করা বা ঢেকে রাখা, মশকের মুখ আঁটকে দেওয়া, দরজা বন্ধ করা এবং এ সময় আল্লাহর নাম উচ্চারণ করা; ঘুমের সময় চেরাগের আগুন নিভিয়ে দেওয়া আর সন্ধ্যার পর শিশু ও গৃহপালিত জন্তুগুলোকে (বাড়িতে) আটকে রাখা উত্তম।

৩. সকাল-সন্ধ্যার দোয়া ও জিকির পড়া।

৪. ঘরে সুরা বাকারা তেলাওয়াত করা। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন-
إِنَّ الشَّيْطَانَ يَنْفِرُ مِنَ الْبَيْتِ الَّذِى تُقْرَأُ فِيهِ سُورَةُ الْبَقَرَةِ
‘যে ঘরে সুরা বাকারা পড়া হয়; শয়তান সে ঘর থেকে পালিয়ে যায়।’ (মুসলিম)

৫. বাড়িতে নফল নামাজ পড়া মোসতাহাব। তবে মসজিদেও পড়া জায়েজ।

৬. সন্ধ্যার সময় আয়াতুল কুরসি পড়া। যা শয়তান কর্তৃক জাকাতের খেজুর চুরির হাদিসে বর্ণিত হয়েছে।

সুতরাং মুমিন মুসলমানের উচিত, জিন ও শয়তান থেকে বেঁচে থাকতে সুন্নাহভিত্তিক আমল ও দোয়া যথাযথভাবে পড়া। হাদিসের উপর যথাযথ আমল করা।

আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে জিনের ক্ষতি থেকে বাঁচার তাওফিক দান করুন। হাদিসে দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যথাযথ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়