ঢাকা, শুক্রবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ৬ ১৪৩১

হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ১৪:৩০, ১৬ জুন ২০২১  

ছবি: সংগৃহীত

ছবি: সংগৃহীত

বাঙালির জাতীয় জীবনের গৌরবোজ্জ্বল দুটি ঐতিহাসিক ঘটনা রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে হাসান হাফিজুর রহমানের নাম ভিন্ন তাৎপর্যে যুক্ত হয়ে আছে একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ এবং ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’ সম্পাদনার কারণে। শুধু তাই নয়, পূর্ববঙ্গের মানুষের ব্যাপক জাগরণ, আত্মপরিচয় সন্ধান এবং আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক মুক্তির কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছে দেওয়া এই ঘটনাদুটির সঙ্গে তিনি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন। দীর্ঘকালের শোষণ-বঞ্চনা এবং সমন্বয়ী সংস্কৃতির উত্তরাধিকার বহনকারী বাঙালি জাতি বিভিন্ন সময়ে স্বদেশি-বিদেশি-বিজাতি শাসক-শোষকদের শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-সংগ্রাম এবং বিদ্রোহ ঘোষণা করলেও রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের যে বীরত্ব ও ত্যাগ তার সঙ্গে অতীতের কোনো সংগ্রামেরই তুলনা চলে না। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন এ অঞ্চলের মানুষের চেতনায় উপ্ত করে ভাষা-সংস্কৃতিভিত্তিক বাঙালি জাতীয়তাবোধ আর মুক্তিযুদ্ধ তাদের পৌঁছে দেয় মুক্তির চূড়ান্ত মোহনায়। এ পথ সহজ ছিলো না; এতে বহু মানুষকে যেমন জীবন দিতে হয়েছে, তেমনি জাতিকে সাঁতরাতে হয়েছে বিশাল রক্তের সমুদ্র; সম্ভ্রমও কম হারাননি এই মাটির জায়া-জননীদের। হাসান হাফিজুর রহমান বাঙালির এই সংগ্রাম এবং অর্জনে কেবল একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারীই নন, এই অর্জনকে মহাকালের যাত্রায় দীপ্ত করে রাখতেও পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সত্তর বছর-পূর্তির মাহেন্দ্রক্ষণ যেমন সমাগত, তেমনি চলছে স্বাধীনতারও পঞ্চাশ বছর পূর্তির মহাআয়োজন। এদিকে হাসান হাফিজুর রহমানেরও জন্মশতবর্ষ করা নাড়ছে, আজ তিনি নিরানব্বইয়ে। এমন আনন্দঘন দিনে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে তাঁর অবদান এবং একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সম্পাদনায় তাঁর সুমহান দায়িত্ব পালনের কথা নতুন প্রজন্মের সামনে তুলে ধরতেই ‘‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ ও হাসান হাফিজুর রহমান শীর্ষক এ প্রবন্ধ-রচনার প্রয়াস। প্রবন্ধটি খানিকটা দীর্ঘ হয়ে গেল, যা পাঠকের বিরক্তির উদ্রেক করতে পারে; তবে জাতির নিজস্ব ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠা এবং আপন গৌরবে এগিয়ে যাওয়ার পথ নির্মাণে যাঁরা অবদান রেখেছেন, তাঁদের কীর্তিগাথা পুনর্বার স্মরণ করতে একটু কষ্ট স্বীকারে আত্মগৌরব বাড়বে বৈ কমবে না, অর্থাৎ এটি পাঠে পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে না বলে আশা রাখি।

২.
হাসান হাফিজুর রহমান শুরু থেকেই রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে সম্পৃক্ত হন। প্রথম পর্বের আন্দোলন অর্থাৎ ১৯৪৮-এর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি ছিলেন ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের ছাত্র। কোনো রাজনৈতিক দল বা ছাত্রসংগঠনের সঙ্গে যুক্ত না থাকলেও এবং ছাত্রসমাজ ও সচেতন বুদ্ধিজীবীদের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সভা-সমাবেশ আয়োজন, পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি ও হরতাল-ধর্মঘটে রাজপথে নামার গুরুত্ব ততটা না বুঝলেও তিনিও তাতে শামিল হন। সহপাঠীদেও সঙ্গে বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ যেমন করেছেন, তেমনি পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলী জিন্নাহর রেসকোর্স ময়দানের সমাবেশেও তিনি উপস্থিত হন। শুধু তাই নয়, শৌখিন ফটোগ্রাফার হিসেবে ঐ সমাবেশের ছবিও তুলেছিলেন। ১৯৪৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রজ্ঞিান বিভাগে ভর্তির পর তাঁর মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্রসংগঠনের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে। মুসলিম লীগের দোর্দণ্ড প্রতাপ ও ধর্মাচ্ছন্ন রাজনীতির বিপরীতে প্রগতিশীলতার দীক্ষা নেন। রাজনীতি অপেক্ষা বেশি ঝুঁকেছিলেন সাহিত্য-সাধনা এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে; যুক্ত হন প্রগতি লেখক সংঘের সঙ্গে। এর ফলে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, বাঙালি সংস্কৃতি এবং ইতিহাস-ঐতিহ্য সম্পর্কে তাঁর মধ্যে সৃষ্টি হয় বাড়তি আগ্রহ ও মমত্ব। বিভিন্ন সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকায় থাকায় স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষা দিতে পারেন নি। ফলে ঐ সময়ই পাস কোর্সে ভর্তি হতে হয় তাঁকে। ১৯৫১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ এবং পরে এমএ ডিগ্রি অর্জন করেন। বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করতেন।
পাকিস্তানের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দীন পূর্ববঙ্গ সফরে এসে ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে মুসলিম লীগের সম্মেলন-সভায় এবং ২৭ জানুয়ারি একই স্থানে আয়োজিত জনসভায় উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেন। একই সঙ্গে বিষোদ্গার করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সম্পর্কে। প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকাসহ প্রায় সমস্ত পূর্ববঙ্গের রাজপথ। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আমাদেও দাবি মানতে হবে’ প্রভৃতি স্লোগানে মুখরিত হয় রাজপথ। আন্দোলনকে সুসংগঠিত করার লক্ষ্যে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীকে সভাপতি করে গঠন করা হয় ‘সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ, এবং আহ্বয়ক নির্বাচিত করা হয় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি কাজী গোলাম মাহবুবকে। এছাড়া পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নেতৃবৃন্দ, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রনেতৃবৃন্দ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হল ছাত্র-সংসদের ভিপি-জিএস, তমদ্দুন মজলিস, ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ, ছাত্র ফেডারেশনসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, ছাত্র ও যুবসংগঠনের নেতা-কর্মীরা ঢাকা ও ঢাকার বাইরের জেলায় জেলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ঘোষণা করা হয় ২১ ফেব্রুয়ারি প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট-কর্মসূচি; ৪ ফেব্রুয়ারি হরতাল পালিত হয়, একের পর আয়োজন করা হয় প্রতিবাদ-সমাবেশ, পালন করা হয় ‘পতাকা দিবস’। আন্দোলনের সুসংগঠিত রূপ এবং প্রতিবাদী চেহারা দেখে ভীত-সন্ত্রস্ত মুসলিম লীগ সরকার তা দমনে সর্বশক্তি নিয়োগ করে। ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪-ধারা জারি করে মিছিল-সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ করা হয়। কিন্তু ছাত্রসমাজ তা মানতে রাজি ছিলেন না; তাই পরদিন তা ভেঙে তাঁরা পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের দম্ভ চূর্ণ করে দেয়। ২১ ও ২২ তারিখে ঢাকার পিচঢালা কালো রাস্তা লাল হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউর, ওহিউল্লাহ, আউয়ালসহ নাম না-জানা অনেক শহীদের রক্তে। এতেও থামে না জনতার রোষ; উত্তাল হয়ে ওঠে পূর্ববঙ্গের সকল অঞ্চল। মিছিল-সমাবেশ এবং জনসভায় বজ্রমুষ্টি আর স্লোগান নিয়ে হাজির হন ছাত্র, যুবক, তরুণ, শিশু, কিশোর, কৃষক, শ্রমিক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী তথা সর্বস্তরের মানুষ। এক কথায়, এমন সম্মিলিত প্রতিবাদ পূর্ববঙ্গের মাটিতে আর কখনো সংঘটিত হয়নি।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে বায়ান্নর রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনের সময় হাসান হাফিজুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন, ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলেন ছাত্ররাজনীতি এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। একুশে ফেব্রুয়ারির আগে-পরে নানা কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করেন। ৪ ফেব্রুয়ারির ধর্মঘটের দিন যোগ দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের পিকেটিংয়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ডিন শাদানী সাহেবের ভাইপো বলে পরিচিত জনৈক উর্দুভাষী ছাত্র ধর্মঘট উপেক্ষা করে ক্লাশে গিয়েছিল। তার ক্লাশে যাওয়ার পথ রোধ করতে ভবনের করিডোরে শুয়ে পড়েন এনায়েদ করিম নামের এক পিকেটার (পরে পররাষ্ট্র সচিব হন)। কিন্তু উর্দুভাষী ছেলেটি তাঁকে ডিঙিয়েই ক্লাশে যায়। এতে আন্দোলনকারীরা চরম ক্ষুব্ধ হন। তাই ক্লাশ শেষে তাকে মধুর কেন্টিনে ডেকে আনা হয়। এ নিয়ে উর্দুভাষী ছাত্রদের সঙ্গে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনকারীদের হাতাহাতি-মারামারির ঘটনা ঘটে। হাসান হাফিজুর রহমান ঐ সময় এতটাই উত্তেজিত হয়ে পড়েন যে, পায়ের জুতা খুলে উর্দুভাষী ছেলেটিকে বেদম প্রহার করেন। পরে শিক্ষকরা ছেলেটিকে উদ্ধার করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি ঘর্মঘটের দিন হাসান হাফিজুর রহমান ১৪৪-ধারা উপেক্ষা করে আমতলার সমাবেশে উপস্থিত হন। এরপর পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদের নির্দেশে তিনি মেডিক্যাল কলেজে ছাত্রাবাসের সামনের গেটে গিয়ে ছাত্রদের পুলিশের প্রতি ঢিল নিক্ষেপে বারণ করেন। এদিকে বেলা ১১টায় শুরু হওয়া আমতলার সমাবেশে রজনীতিবিদ ও ছাত্রনেতাদের পাল্টাপাল্টি বক্তৃতাশেষে ছাত্রদের দৃঢ় ইচ্ছারই জয় হয়। ভঙ্গ করা হয় ১৪৪-ধারা। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আবদুল মতিনের বক্তৃতার পর সভার সভাপতি গাজিউল হক ঝাঁঝালো ভাষায় বক্তৃতা দিয়ে ছাত্রদের দাবির পক্ষে নিজের সমর্থন ব্যক্ত করেন। তাঁর বক্তৃতা শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র-ছাত্রীরা ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আমাদের দাবি মানতে হবে’ স্লোগান দিতে দিতে ১৪৪-ধারা ভেঙে পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হয়। পুলিশি বাধা, ছাত্রদের প্রতিরোধ এবং সংঘর্ষের মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান অলি আহাদের নির্দেশ পালনে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রবাস-সংলগ্ন গেটের সামনে উপস্থিত হন। তাঁর উপস্থিত হওয়ার কিছুক্ষণ পরেই গুলিবর্ষণ শুরু হয়। প্রথম শহীদ হন রফিকউদ্দিন আহমদ, এরপর আবুল বরকত। ঐ সময়ে আরও হতাহতের ঘটনা ঘটে। পুলিশের গুলিবর্ষণের পর ছাত্ররা তাৎক্ষলিক হতভম্ভ হয়ে যায় এবং ক্ষোভে ফেটে পড়ে। ঐ সময় পরিষদ ভবনের সভা থেকে ওয়াক আউট করে বের হয়ে আসেন মুসলিম লীগ নেতা ও পরিষদ সদস্য মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশসহ বেশ কয়েকজন রাজনীতিবিদ। তাঁরা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে হতাহতদের রক্তাক্ত দেহ দেখে রাগে-ক্ষোভে-শোকে এবং প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ অনলবর্ষী ও আবেগদীপ্ত ভাষায় বক্তৃতা দেন। ঢাকা শহরে ছড়িয়ে পড়ে প্রতিবাদের আগুন। গুলিবর্ষণের পর হাসান হাফিজুর রহমান, আমির আলীসহ আরও একজন ছাত্র প্রথমে মধুর কেন্টিনে ফিরে যান এবং পরে জেলখানার উল্টোদিকে ক্যাপিটাল প্রেসে হাজির হন। তাঁরা সেখানে বসে একটি লিফলেট প্রস্তৃক করেন এবং শিরোনাম দেন : ‘মন্ত্রী মফিজউদ্দীনের আদেশে গুলী’। এরপর বিকেল সাড়ে চারটার দিকে দু-তিন হাজার লিফলেট নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ফিরে আসেন এবং পরে চকবাজার, নাজিরাবাজারসহ ঢাকা শহরের বিভিন্ন এলাকায় সেগুলো বিতরণের ব্যবস্থা করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি পার্টির পক্ষ থেকে হাসান হাফিজুর রহমানকে আরও একটি লিফলেট ছাপানোর দায়িত্ব দেওয়া হয়। লিফলেটটি ছাপা হলে তাঁর ছোট ভাই চাদরে ঢেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে পৌঁছে দেন। ২২ ফেব্রুয়ারি তিনি বিক্ষোভ-মিছিলে যোগ দেন। মিছিলটি আবদুল গনি রোড থেকে গুলিস্তানের দিকে অগ্রসর হলে পুলিশ হামলা চালায়। হাসান হাফিজুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গীরা মিছিলে পুলিশের হামলার পর কার্জন হলের বড় গেট টপকে সেখানে প্রবেশ করেন। সেখানে প্রবেশ করে দেখেন চারপাশে পুলিশ পজিশন নিয়ে আছে। তিনি এবং তোফাজ্জল হোসেন (কবি তারিক সুজাতের বাবা; পরবর্তী কালে তথ্য মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা) ঐ সময় কার্জন হল ঘুরে ঘুরে নাজিমদ্দীন রোডের দিকে যান। যাত্রাপথে দেখেন ফজলুল হক হল, সলিমুল্লাহ মুসলিম হল এবং সেক্রেটারিয়েটের দিকে অসংখ্য পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। পুলিশের যুদ্ধংদেহী সাজ ও মনোভাব দেখে তাঁরা হতচকিয়ে যান। এরপর আবারও মিছিলে যোগ দিয়ে পুলিশের বাধার মুখে পড়েন। ঢালধারী পুলিশদের হামলায় মিছিল দু-ভাগে বিভক্ত হয়ে একটি অংশ নাজিরা বাজারের দিকে এবং আরেকটি অংশ হাইকোর্টের দিকে যায়। পুলিশের মুহুর্মুহু হামলার মধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান এবং তাঁর সঙ্গীরা মিছিল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। ২২ ফেব্রুয়ারি সরকারের সশস্ত্রবাহিনীর গুলিতে ও হামলায় শহীদ হন শফিউর রহমান, ওহিউল্লাহ এবং আউয়ালসহ অনেকে। আহত হন অগণিত মানুষ। ২১ এবং ২২ ফেব্রুয়ারির পরেও হাসান হাফিজুর রহমান বিভিন্ন মিছিল-সমাবেশে অংশগ্রহণ করেন।
একজন প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণকারী হিসেবে হাসান হাফিজুর রহমান এভাবেই রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। শুধু তাই নয়, সেই গৌরবময় অন্দোলন ও রক্তাক্ত ঘটনার স্মৃতি লিখেও রেখে গেছেন। তাঁর মতে, ঐ সময় বিভিন্ন ছাত্রসংগঠনের নীতি-আদর্শ ও কর্মসূচিতে ভিন্নতা থাকলেও রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রশ্নে প্রায় সকল সংগঠনই একমত ছিলেন। বিভিন্ন সংগঠন ভিন্ন ভিন্ন সিদ্ধান্তে আন্দোলনে শামিল হলেও আন্দোলনের চরম মুহূর্তে সকলের সিদ্ধান্তই ভেস্তে গিয়েছিলো। চূড়ান্ত পর্যায়ে আন্দোলনের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা। মুসলিম লীগ সরকার সর্বশক্তি নিয়োগ করেও আন্দোলন থামাতে পারেনি। একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে এই আন্দোলনের বহুমাত্রিক ঘটনার নানা প্রসঙ্গ তিনি উল্লেখ করেছেন। কিছু তিক্ত স্মৃতিও তাঁর ভান্ডারে জমা ছিলো; যা তুলে ধরে বিভিন্ন সংগঠনের অবদান সম্পর্কে হাসান হাফিজুর রহমান লিখেছেন : ‘৫২-এর ভাষা আন্দোলনে যাঁরা নেতৃত্ব দিয়েছিলেন তাঁদের সকলেই রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। সাধারণ ছাত্ররা বিভিন্ন মতাবলম্বী হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষার প্রশ্নে একটি প্লাটফর্মে এসে সরকারের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে মুখর হয়েছিল। সে সময় সাধারণ ছাত্রদের তরফ থেকে প্রচুর টাকা সংগ্রহ করা হয়েছিল। সে সময় এসএম হলের রাষ্ট্রভাষা তহবিলের ট্রেজারার ছিলেন আখতারউদ্দিন। ভাষা আন্দোলনের জন্য সংগৃহীত টাকা তার কাছেই গচ্ছিত ছিল। কিন্তু পরবর্তীকালে এসব টাকা-পয়সার ঠিকঠাক হিসাব পাওয়া যায়নি বলেই শুনেছি। আখতারউদ্দিন পরে ব্যারিস্টারি পড়তে লন্ডন চলে গিয়েছিলেন। কমিউনিস্ট পর্টি, আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং তাদের অঙ্গসংগঠন ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। ... মুসলিম লীগ ছাড়া অন্য প্রায় সব রাজনৈতিক দলই পরোক্ষ বা প্রত্যক্ষভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনকে সমর্থন করেছে।’

৩.
রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন ও একুশের চেতনা হাসান হাফিজুর রহমানের মর্মমূলে প্রোথিত হয়েছিল। তাই বায়ান্নর পরেও তিনি সক্রিয় থেকেছেন এর প্রচার-প্রসারে। ভাষাশহীদদের মহান আত্মত্যাগের স্মৃতি এবং একুশের চেতনার মশাল হাতে তিনি নব-উদ্যেমে মাঠে নেমেছেন। কখনো লেখনীর মাধ্যমে, কখনো সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড দ্বারা, আবার কখনো রাজপথের ঝাঁঝালো মিছিলে অংশগ্রহণ করে এই অবিনাশী চেতনা-বিস্তারে কাজ করেছেন। তাঁর সেই কর্মতৎপরতার দীপ্ত প্রকাশ আমরা লক্ষ করি একুশের প্রথম সংকলন ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সম্পাদনার মধ্যে। সংকলনটি প্রকাশিত হয় ১৯৫৩ সালের মার্চ মাসে। প্রকাশক ছিলেন মোহাম্মদ সুলতান এবং এম আর আখতার মুকুল। প্রকাশ করে ঢাকার পুঁথিপত্র প্রকাশনী। প্রচ্ছদ এঁকেছিলেন শিল্পী আমিনুল হক, রেখাঙ্কন করেন মুর্তজা বশীর এবং বিজন চৌধুরী। স্বহচ্ছে উৎসর্গপত্র লিখেছিলেন আনিসুজ্জামান, যাতে বলা হয় : ‘যে অমর দেশবাসীর মধ্যে মধ্য থেকে জন্ম নিয়েছেন/একুশের শহীদেরা,/যে অমর দেশবাসীর মধ্যে অটুট হয়ে রয়েছে/একুশের প্রতিজ্ঞা, - /তাঁদের উদ্দেশ্যে’। সেই মাহেন্দ্রক্ষণের স্মৃতিচারণ করে পরবর্তী কালে আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘‘হাসান একদিন বললেন, ‘একটা উৎসর্গপত্র লেখো।’ তিনিও লিখতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু মন দিতে পারলেন না। কিছু কাটাকুটির পর আমি একটা দাঁড় করালাম - হাসানের পছন্দ হলো। সঙ্গে হেঁটে বাদামতলিতে ব্লক প্রস্তুতকারকের দপ্তরে যাওয়া হলো। সেখানেই ট্রেসিং পেপারে, সরু নিবের কলমে, চাইনিজ ইংকে ওটা নকল করে দিলাম। তা ব্লক করে উৎসর্গ ছাপা হলো আমার অস্পষ্ট হাতের লেখায়, বাঁকা হয়ে যাওয়া লাইনে।’  উৎসর্গের পর অন্য লেখাগুলো একসঙ্গে করে মুদ্রণের কাজ শুরু হয়। তার ব্লক তৈরি করে বাদামতলির এইচম্যান কোম্পানি। পাইওনিয়ার প্রেসের পক্ষে এটি ছাপেন এম. এ. মুকিত। ১৮৩ পৃষ্ঠার ক্রাউন সাইজের সংকলনটির মূল্য রাখা হয় দুই টাকা আট আনা। প্রকাশের পরপরই সেই সংকলটি বাজেয়াপ্ত করা হয়, পরে ১৯৫৬ সালে সেই বাজেয়াপ্তের নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের প্রথম সংস্করণে স্থান পাওয়া লেখাগুলো ছিলো : একুশে ফেব্রুয়ারী (সম্পাদকীয়); সকল ভাষার সমান মর্যাদা (প্রবন্ধ, আলী আশরাফ); একুশের কবিতা (শামসুর রাহমান, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গনি হাজারী, ফজলে লোহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালউদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান); একুশের গল্প : মৌন নয় (শওকত ওসমান), হাসি (সাইয়িদ আতীকুল্লাহ), দৃষ্টি (আনিসুজ্জামান), পলিমাটি (সিরাজুল ইসলাম), অগ্নিবাক (আতোয়ার রহমান); একুশের নকসা : একটি বেওয়ারিশ ডায়েরীর কয়েকটি পাতা (মুর্তজা বশীর), অমর একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত স্বাক্ষর (সালেহ আহমদ); একুশের গান (আবদুল গাফফার চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন); এবং একুশের ঘটনাপঞ্জি (কবিরউদ্দিন আহমদ)। পরবর্তীকালে এ সংকলনে আরও কিছু লেখা সংযোজিত হয়; সেগুলো ছিলো : সিকান্দার আবু জাফর-রচিত গান, মুনীর চৌধুরীর নাটক (কবর), আবদুল লতিফ-রচিত গান (‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইরা নিতে চায়’), মোহাম্মদ সুলতানের সাক্ষাৎকার, হাসান হাফিজুর রহমানের স্মৃতিচারণ, হাসান হাফিজুর রহমান ও এম আর আখতার মুকুলের জীবনী এবং পুঁথিপত্র প্রকাশনীর জন্মবিবরণ। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনের প্রতিটি লেখায় একুশের চেতনার বারুদে ভরা ছিলো। শামসুর রাহমান ক্ষোভে ফেটে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘তোমরা নিশ্চিহ্ন করে দাও আমার অস্তিত্ব¡,/পৃথিবী হতে চিরদিনের জন্যে নিশ্চিহ্ন করে দাও/উত্তরাকাশের তারার মতো আমার ভাস্বর অস্তিত্ব,/নিশ্চিহ্ন করে দাও, নিশ্চিহ্ন করে দাও॥’ বোরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীরের প্রতিবাদী কণ্ঠে ধ্বনিত হয় : ‘এখনো/এখনো যে বরকতের আর্তনাদ গুলির আওয়াজ/অণু দুরন্ত আক্রোশে বারে বারে খুনীকে খোঁজে।’ আবদুল গনি হাজারী ফাল্গুনের রৌদ্রতপ্ত তৃষিত মাটিতে ওঠা একুশের ঝড়ের কালো মেঘের মাঝে অমৃতক্ষণ ও অরুণ জীবনের হাতছানি দেখতে পেয়েছিলেন। বায়ান্নর একুশ বাংলাভাষা, সাহিত্য এবং বাঙালি সংস্কৃতিতে যে জাগরণ সৃষ্টি করেছিলো, তার মধ্যে অপার সম্ভাবনা দেখতে পেয়ে গনি হাজারী লিখেছিলেন : ‘এই মেঘে আসবে বর্ষণ/এই মেঘে বুনে যাবে/অসংখ্য জীবন।।’ ফজলে লোহানী ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মধ্যে নতুন জাগরণ এবং নতুন দিনের আভাষ পেয়েছিলেন, সেজন্যে লিখেছিলেন : ‘মায়েরা সব গেয়ে ওঠো - /আর চুপ নয়, এবার শুধু/শহীদের গান। বিজয়ের গান॥/শহরে যাদের মৃত্যু হয়েছে,/ফিরে আসছে, ফিরে আসছে,/হাজারে হাজারে মিছিল করে॥’ আলাউদ্দিন আল আজাদ শহীদদের স্মৃতির মিনার গুঁড়িয়ে দেওয়ায় ক্ষোভে-আত্মবিশ্বাসে উচ্চারণ করেছিলেন : ‘ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। একটি মিনার গড়েছি আমরা/চারকোটি কারিগর/ বেহালার সুরে, রাঙা হৃদয়ের বর্ণরেখায়।’ একইভাবে অনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক, হাসান হাফিজুর রহমান তাঁদের কবিতাগুলোতে বাংলা ভাষা, বাঙালির গৌরব এবং ভাষাশহীদদের আত্মত্যাগের মাহাত্ম্য তুলে ধরে কবিতাগুলোকে যেন একুশের চেতনার একেকটি অবিনশ^র মিনাওে পরিণত করেন। হাসান হাফিজুর রহমান লেখেন : ‘আর এবার আমরা হারিয়েছি এমন কয়েকজনকে/যাঁরা কোনদিন মন থেকে মুছবে না,/কোনদিন কাকেও শান্ত হতে দেবে না;/যাঁদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল/ দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল/ দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।/আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার/কি আশ্চর্য, কি বিষণœ নাম! একসার জ¦লন্ত নাম ॥’ ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে আবদুল গাফফার চৌধুরীর যে গানটি স্থান পেয়েছিলো, সেই ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারী’ গানটি একুশের চেতনার প্রাণভোমড়া হয়ে গত প্রায় পৌনে এক শতাব্দী বাঙালির চেতনাকে শাণিত করেছে। বর্তমানে তা ছড়িয়ে পড়েছে দেশ থেকে দেশান্তরে। তোফাজ্ঝল হোসেনের গানটিতে রক্তশপথে একুশকে স্মরণ করা হয়েছে। এ সংকলনের ‘একুশের ঘটনাপঞ্জী’ শীর্ষক লেখাটি ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের অকাট্য দলিলের মর্যাদা লাভ করেছে। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনের ঘটনাপ্রবাহ এভাবে এর আগে আর কোথাও তুলে ধরা হয়নি। এছাড়া শওকত ওসমানসহ কয়জন গল্পকার ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনে যে প্রভাতরশ্মির আলো ছড়িয়েছিলেন, যা ক্রমে বিকীর্ণ হয়ে মধ্যাহ্ন সূর্যের দীপ্তির মতো বাংলা সাহিত্যের আকাশকে আলোকিত করেছে।

৪.
মাত্র কুড়ি বছর বয়সে হাসান হাফিজুর রহমান তাঁর বন্ধুদের সঙ্গে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামক এমন একটি সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন, যা আজও আমাদেও বিস্ময় উদ্রেক করে। একুশের সংকলন সম্পাদনা ও প্রকাশের সেই অবিনশ্বর স্মৃতি স্মরণ করে আনিসুজ্জামান লিখেছেন : ‘‘হাসানের মাথায় ঘুরতে থাকলো, পরের একুশে ফেব্রুয়ারির আগে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলন নিয়ে একটা সাহিত্য-সংকলন প্রকাশ করতে হবে। পাইওনিয়ার প্রেসে বাকিতে বই ছাপার ব্যবস্থা হলো, বাদামতলির এইচম্যান কোম্পানিও ভরসা দিলেন বাকিতে ব্লক তৈরি করে দেবেন। পরিচিত সবার কাছেই হাসান লেখা চাইলেন। এমন সময়ে জেলখানার ভেতর থেকে কমিউনিস্ট-নেতা খোকা রায়ের চোরা-পথে পাঠানো প্রবন্ধ ‘সকল ভাষার সমান মর্যাদা’ আব্দুল্লাহ্ আল-মুতীর কাছে পৌঁছোলো। অতি ক্ষুদ্রাক্ষরে লেখা প্রবন্ধটি আমি হাতে কপি করি। স্থির হয়, হাসানের পরিকল্পিত সংকলনে এটাই যাবে একমাত্র প্রবন্ধ হিসেবে—লেখকের নাম দেওয়া হয় আলী আশরাফ। হাসানের অনুরোধে সংকলনের জন্যে আমি একটা গল্প লিখে ফেললাম। হাসান বললেন, তার আরম্ভটা খুব ভালো হয়েছে, সমাপ্তিটা নিরাশ করে। কদিন পরে শেষটা বদলে হাসানের হাতে ‘দৃষ্টি’ সমর্পণ করলাম। ভাষা আন্দোলন-উপলক্ষে শামসুর রাহমানের কোনো কবিতা ছিল না; তাগাদা দিয়েও যখন তা পাওয়া গেল না, তখন কলকাতার পরিচয় পত্রিকায় তাঁর সদ্যপ্রকাশিত একটি কবিতা সংকলনের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিলেন হাসান। আর সংকলিত হলো আবদুল গনি হাজারী, আনিস চৌধুরী, ফজলে লোহানী, আতাউর রহমান, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আলাউদ্দীন আল আজাদ, বোরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর, সৈয়দ শামসুল হক ও জামালউদ্দীনের কবিতা - হাসানেরটা তো আছেই; শওকত ওসমান, সায়িদ আতীকুল্লাহ, আতোয়ার রহমান, সিরাজুল ইসলামের গল্প এবং আমারটাও; মুর্তজা বশীর ও সালেহ আহমদের নকশা; আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী ও তোফাজ্জল হোসেনের গান এবং কবিরউদ্দিন আহমদের লেখা ঘটনাপঞ্জি। আমিনুল ইসলাম প্রচ্ছদ আঁকলেন; মুর্তজা বশীরের একটা লিনোকাট গেল মুখপাতে; পাদপূরণের জন্যে বিজন চৌধুরী ও বশীরের কয়েকটি স্কেচ গেল - তবে বইতে বিজনের নাম যায়নি। হাসানের সঙ্গে ভাগাভাগি করে আমরা দু-একজন প্রুফ দেখলাম। কিন্তু সম্পাদকীয় গোছের কিছু একটা যাওয়া দরকার। হাসান হঠাৎ ঘোষণা করলেন, তিনি আর লিখতে পারবেন না। শেষে ওই দায়িত্ব পড়লো আল-মুতীর ঘাড়ে - তিনি পরদিনই সেটা এনে দিলেন। মুখবন্ধ হিসেবে ওটাই ছাপা হলো স্বাক্ষরবিহীনভাবে।’ 
একুশে ফেব্রুয়ারী সংকলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন শিল্পী মুর্তজা বশীর। এ সংকলন প্রসঙ্গে তিনি লিখেছেন : ‘‘সেই উপলক্ষে হাসান যখন আমাকে বললো, আমি কোনো লেখা দিতে পারি কি না। তখন এই একুশে ফেব্রুয়ারী বইতে আমি কয়েকটি পাতা ভরে একটি লেখা লিখি, যাতে লেখা ২০ তারিখ, ২১ তারিখ এবং ২২ তারিখের আংশিক ঘটনা। তবে এখানে যা আমি লিখি, তা একজন লেখকের সঙ্গে কল্পনা ছিল না। পুরোপুরি যা দেখেছি - যা শুনেছি - শব্দনিষ্ঠভাবেই সেগুলোকে আমি লিখেছি। তবে হাসান এই বইয়ের জন্য পরে আমাকে কয়েকটি ইলাস্ট্রেশন করতে বলে। গোটা চারেক ইলাস্ট্রেশন করেছিলাম। তবে এই বইতে একটি লিনোকাট দিই, যা আমি ’৫২-র ভাষা আন্দোলনের পরপরই স্বতঃস্ফূর্তভাবে লিখি। ... হাসান হাফিজুর রহমান-সম্পাদিত এই একুশে ফেব্রুয়ারী গ্রন্থটির প্রচছদ আঁকেন আমার অগ্রজ শিল্পী আমিনুল ইসলাম এবং এই বইটি খুললেই যে ‘একুশে ফেব্রয়ারী’ বলে একটি লেখা দেখা যায় হাতে লেখা, সেটি আমার। পুঁথিপত্র প্রকাশনীর যে মনোগ্রাম, সেটি আমি করেছিলাম এবং পড়তে গিয়ে পাঁচ লাইনের যে লেখা, সেটি আনিসুজ্জামানের।” (মুর্তজা বশীর, ‘একুশের প্রথম সংকলনের লেখক ও ভাষা-আন্দোলন’) একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির ইতিহাসে গতানুগতিক কোনো ঘটনা ছিলো না, এটি ছিলো জাতীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী প্রভাব-বিস্তারী এক ঐতিহাসিক ঘটনা। হাসান হাফিজুর রহমান একুশে ফেব্রুয়ারী গ্রন্থে লিখেছেন : ‘একটি মহৎ দিন হঠাৎ কখনো জাতির জীবনে আসে যুগান্তরের সম্ভাবনা নিয়ে। পূর্ব পাকিস্তানের ইতিহাসে একুশে ফেব্রুয়ারী এমনি এক যুগান্তকারী দিন। শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশের ইতিহাসে নয়, একুশে ফেব্রুয়ারী সারা দুনিয়ার ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ঘটনা। দুনিয়ার মানুষ হতচকিত বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়েছে মাতৃভাষার অধিকার রক্ষার জন্য পূর্ব-পাকিস্তানের জনতার দুর্জয় প্রতিরোধের শক্তিতে, শ্রদ্ধায় মাথা নত করেছে ভাষার দাবীতে পূর্ব-পাকিস্তানের তরুণদের এই বিশ্ব ঐতিহাসিক আত্মত্যাগে। জাতিগত অত্যাচারের বিরুদ্ধে, জনতার গণতান্ত্রিক অধিকারের জন্য দুনিয়াজোড়া মানুষের যুগ যুগ ব্যাপী যে সংগ্রাম, একুশে ফেব্রুয়ারী তাকে এক নতুন চেতনায় উন্নীত করেছে।’ 
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন প্রকাশে মূল প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে একুশের চেতনা। আর্থিক সঙ্কট, শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু কোনো কিছুই সংশ্লিষ্টদের দমিয়ে রাখতে পারেনি। প্রকাশক মোহাম্মদ সুলতান লিখেছেন : ‘‘তেপ্পান্ন সালের প্রথমদিকে হাসান প্রস্তাব দিল, ’৫২-এর উত্তাল ভাষা-আন্দোলনের সময়ে আমাদের দেশের সুধী লেখকসমাজ তুলির কলমের আঁচড়ে যা লিপিবদ্ধ করেছেন, পুস্তকাকারে তা প্রকাশ করা যায় কিনা। ... সেই সময়ে একুশে ফেব্রুয়ারী বইটা বের করতে সেই মুহূর্তেই ৫০০ টাকার প্রয়োজন। আমার আর হাসানের হাতে ৫০ টাকাও নেই। সমাধান করে দিল হাসান। বাড়িতে গিয়ে জমি বেচে সে টাকা নিয়ে আসবে। যা ইচ্ছা তা চিন্তা হাসান তাই করল। কথা দিলাম বই বিক্রি করে তার টাকা ফেরত দেবো। বই আমরা ছেপেছিলাম, বইয়ের প্রচারও যথেষ্ট হয়েছিল, ক্রেতার ভিড়ও হয়েছিল। বইটার দাম রেখেছিলাম আড়াই টাকা। ১৯৫৩ সালের মার্চের শেষদিকে বইটা বেরুল আর সে বছরই বাজেয়াপ্ত হয়ে গেল। ১৯ তারিখের দুপুরে লালবাগ থানার দুই ট্রাক পুলিশ এসে দোকান তছনছ করে দিয়ে গেল। ... ছাপ্পান্ন সাল পর্যন্ত বইটি সরকার-কর্তৃক বেআইনি ও নিষিদ্ধ ঘোষিত ছিল।’’ 
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলনটি ইতিহাস এবং সংস্কৃতি উভয় দিক থেকেই গুরুত্ব বহন করে। এতে লেখার বৈচিত্র্য ও মান দু-ই ছিল। লেখক বাছাইয়েও ছিল দূরদৃষ্টি। এই সংকলনের লেখকগণ পরবর্তীকালে প্রায় সকলেই নিজেদের প্রতিভার বিকাশ ঘটিয়ে বাংলা সাহিত্যে অবস্থান সুদৃঢ় করেছিলেন। সংকলনটি সম্পাদনা ও প্রকাশ করে তরুণ বয়সে হাসান হাফিজুর রহমান ও তাঁর সঙ্গীরা যে দ্যুতি ছড়িয়েছিলেন, তা বাঙালির জীবন ও সাহিত্যকে আলোকিত করে দীর্ঘকাল। আজও করছে, বললে অত্যুক্তি হয় না। বলা এ সংকলন ছিলো একুশের চেতনায় জাগ্রত তরুণদের প্রত্যয়ী কণ্ঠস্বর। আবদুল মান্নান সৈয়দ ঠিকই লিখেছেন : ‘তারুণ্যের যে অগ্নি সেদিন প্রজ্বলিত করেছিলেন হাসান হাফিজুর রহমান আর তার সাথীরা, আজো তা অনির্বাণ, অনির্বাণই থাকবে চিরকাল।’ (সূত্র : আবদুল মান্নান সৈয়দ, ‘একুশের প্রথম সংকলন’) প্রকাশকের কাছে জমি বিক্রি করে টাকা দেওয়ার কথা বললেও, হাসান হাফিজুর রহমান শেষপর্যন্ত মায়ের গহনা বিক্রি করে টাকা সংগ্রহ করেছিলেন। 
সমকালীন যুগ-পরিবেশে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সম্পাদনা হাসান হাফিজুর রহমানের সত্যিই এক দুঃসাহসিক ও ঐতিহাসিক কাজ ছিলো। এর আগে সুকান্ত ভট্টাচার্য পঞ্চাশের মন্বন্তর নিয়ে ‘আকাল’ (১৯৪৫) এবং দাঙ্গা নিয়ে বীরেন্দ্র চট্টোপধ্যায় ‘কবিতা সংকলন’ প্রকাশ করলেও হাসান হাফিজুর রহমানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন হিসেবে অনবদ্য। পঞ্চাশের দশকে একুশের চেতনা ধারণ করে বাংলা সাহিত্যে যে বাঁকবদল ঘটেছিল, তার ভিত্তি স্থাপিত হয় এর মাধ্যমে। ১৯৫৪ সালে এই সংকলন সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সাাদেক খান লিখেছিলেন : ‘পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্য বিকাশের ধারা লক্ষ্য করলে বলা চলে, একুশের বৈপ্লবিক দিনটির মতো এই বইটিও সাহিত্য ক্ষেত্রে একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। রাজনৈতিক বিষয়বস্তুর উপর একসাথে এতগুলো শিল্পোত্তীর্ণ রচনা এই প্রথম।’ (সূত্র : সাদেক খান, সওগাত, মাঘ ১৩৬০) ১৯৮৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এর পাঁচটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়। বাস্তবেই এটি ছিলো দুর্মর সাহসী পদক্ষেপের ফসল। এই সংকলন চিন্তা ও বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ-দেশের সাংস্কৃতিক জীবনের নবজীবন আনয়ন করে। এর মাধ্যমে হাসান হাফিজুর রহমান বাঙালির মন-মননে প্রগতিশীলতা ও একুশের চেতনার যে অগ্নিবীজ বপন করেছিলেন, তা পরবর্তীকালে মহীরুহে পরিণত হয়ে জাতিকে দেখিয়েছে মুক্তির নিশানা। সংকলটিকে তাই আজও মনে হয় ‘আমাদের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি-সমাজ রাজনীতি ইত্যাদি সামগ্রিক জীবনেরই এক দিকদর্শী নক্ষত্রের মতো।’ (আবদুল মান্নান সৈয়দ, পূর্বোক্ত) লেখকগণ অধিকাংশই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে রাষ্ট্রভাষা-আন্দোলনে সংশ্লিষ্ট ছিলেন বলে তাঁদের লেখনীতে তীক্ষ্ন ধার লক্ষ করা যায়। সংকলনটির জন্য হাসান হাফিজুর রহমান ও সংশ্লিষ্টরা বাঙালির ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

৫.
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ সংকলন হাসান হাফিজুর রহমানকে বাংলা ভাষা, সাহিত্য এবং বাঙালির ইতিহাসে মহিমান্বিত করে রাখলেও এর মধ্যেই তিনি নিজের কর্ম সীমাবদ্ধ রাখেননি। অফুরন্ত প্রাণশক্তি এবং সৃষ্টি ও মননশীলতা দ্বারা বাংলা সাহিত্য ও বাঙালির ইতিহাসকে ঐশ্বর্যমণ্ডিত করেছেন। শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে তাঁর সম্পাদিত ১৬ খণ্ডের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ : দলিলপত্র’-এর কথা। একজন সাংবাদিক হিসেবেও তিনি খ্যাতিলাভ করেছিলেন। সাপ্তাহিক বেগম, সওগাত, ইত্তেহাদ, দৈনিক পাকিস্তান, দৈনিক বাংলা প্রভৃতি পত্রিকায় তিনি স্বীয় মেধা ও কর্মেও স্বাক্ষর রেখে গেছেন। জগন্নাথ কলেজের বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অধ্যাপক হিসেবে জাতির মেধা-মননের পরিচর্যায়ও ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ছিলেন মস্কোর বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রেস কাউন্সিলর। একজন প্রগতিশীল মানুষ এবং বামরাজনীতির ধারক এবং মুক্তবুদ্ধির সাংস্কতিৃক সংগঠক হিসেবে রেখেছেন অসামান্য অবদান। ষাটের দশকে রবীন্দ্র সংগীত নিষিদ্ধ করার ষড়যন্ত্র রুখে দিতে ছিলেন সক্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গণেও লড়েছেন বীরদর্পে। সাহিত্যিক হিসেবে হাসান হাফিজুর রহমানের দান অনেক। তাঁর রচিত গ্রন্থগুলো হলো : বিমুখ প্রান্তর, আর্ত শব্দাবলী, আধুনিক কবি ও কবিতা, মূল্যবোধের জন্যে, অন্তিম শরের মতো, যখন উদ্যত সঙ্গীন, শোকার্ত তরবারী, প্রতিবিম্ব, আরো দুটি মৃত্যু, ভবিতব্যের বাণিজ্যতরী, সাহিত্য প্রসঙ্গ, আলোকিত গহ্বর, সীমান্ত শিবিরে প্রভৃতি। তিনি বাংলা ভাষায় অনুবাদ করেছিলেন হোমোরের ‘ওডিসি’। সাহিত্য-সাধনা এবং কর্মের স্বীকৃতিস্বরূপ লাভ কেেছন স্বাধীনতা পুরস্কার, একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননা। তিনি জন্মেছিলেন ১৯৩২ সালের ১৪ জুন; পৈত্রিক নিবাস জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার কুলকান্দি গ্রাম। ১৯৮৩ সালের ১ এপ্রিল এই কীর্তিমান বাঙালি মস্কোতে মৃত্যুবরণ করেন। আজ তাঁর নিরানব্বইতম জন্মদিন। নতুন প্রজন্ম ধারণ করুক তাঁকে, অবক্ষয়পিষ্ট সমাজে তাঁর জীবন ও কর্মের দীপ্তি জাতিকে দেখাক আলোর পথ।

সর্বশেষ
জনপ্রিয়