ঢাকা, শুক্রবার   ২৬ এপ্রিল ২০২৪ ||  বৈশাখ ১৩ ১৪৩১

মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়ন এবং আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনা

নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২০:১৫, ৫ জুলাই ২০২২  

২০০৯-১০ সাল থেকে আমরা মেগাপ্রকল্প শব্দজোড়ের সঙ্গে পরিচিত হতে শুরু করি। রাজনীতিতে সরকারবিরোধীরা মেগাপ্রকল্প নিয়ে নানা ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ ও সমালোচনা করে আসছে। তাদের ভাষায় মেগাপ্রকল্প মানে মেগাদুর্নীতি। অনেকে তাদের এসব বিশ্বাস ও কথায় আস্থাও রাখে।

বড় মাপের কোনো রাজনীতির আলোচনা-সমালোচনায় মেগাপ্রকল্পের বিরুদ্ধে মেগাদুর্নীতির অভিযোগ প্রকাশ্যে করে বেড়ানো হচ্ছে। তখন অনেকের কাছেই মেগাদুর্নীতি কথাটি লুফে নেওয়ার মতো। কিন্তু যাঁরা অভিযোগ করছেন তাঁদের হাতে কি কোনো তথ্য-প্রমাণ আছে? নাকি সবটাই অনুমাননির্ভর, অনেকটাই শোনা কথা। মেগাপ্রকল্পে দুর্নীতি কতটা হয় বা না হয় সেটা প্রমাণের সুযোগ আমাদের হাতে নেই। তবে মেগাপ্রকল্প গ্রহণ করার প্রয়োজনীয়তা ও সক্ষমতা ছাড়া সরকার এতগুলো মেগাপ্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করতে পারত কি না, সেটা বড় জিজ্ঞাসা। বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রায় ৪০ বছর চলেছে ছোট-মাঝারি নানা প্রকল্প বাস্তবায়ন করে। অতীতে দেশের অর্থমন্ত্রীরা ব্রিফকেস ভর্তি প্রকল্পের নথিপত্র নিয়ে প্যারিস কনসোর্টিয়ামে হাজির হতেন। সেখান থেকে ফিরে এসে বাজেট দিতেন। বাজেটের ৮০-৯০ শতাংশেই বিদেশি ঋণদানকারী সংস্থার নানা শর্ত জুড়ে দেওয়া হতো। আমরা তাদের ‘দাতা সংস্থা’ বলে কতই না সম্মান করেছি! বাস্তবে আমাদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হতে এসব ঋণ খুব কমই অবদান রেখেছে। যদি অবদানই রাখত তাহলে লোডশেডিংয়ের যন্ত্রণায় আমাদের এভাবে ভুগতে হতো না, অর্থনৈতিকভাবেও পিছিয়ে পড়তে হতো না।

বাংলাদেশ ১৯৯৬ সালের পর প্যারিস কনসোর্টিয়াম বৈঠক বাদ দিয়ে ঢাকায় উন্নয়ন সহযোগীদের পরামর্শ, ঋণ ও অনুদান নেওয়ার ধারা চালু করে। এতে আমাদের প্রয়োজনীয়তাকে বিবেচনায় নিয়েই ঋণ গ্রহণ করা হয়। ২০০৯-১০ সাল থেকে বাংলাদেশ ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। এখান থেকেই নানা মেগাপ্রকল্পে দেশ অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা হাতে নেয়। পদ্মা সেতু ঋণের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকসহ বড় বড় ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশকে অবজ্ঞা করেছিল। কিন্তু সেই অবজ্ঞাকে তুচ্ছজ্ঞান করে নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণে বাংলাদেশ হাত দেয়। সঙ্গে সঙ্গে অন্য দাতা সংস্থাগুলো বেশ কিছু মেগাপ্রকল্পে ঋণদানে নড়েচড়ে ওঠে। এরই মধ্যে পদ্মা সেতু নির্মাণ সমাপ্ত হয়, উদ্বোধনও হয়ে যায়। আগামী ডিসেম্বরে কর্ণফুলী বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। আগামী বছরই রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে রেল চালু হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন হয়েছে। মেট্রো রেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েও চালু হতে যাচ্ছে।

বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বেশ কিছু মেগাপ্রকল্পের সুবিধা পেতে যাচ্ছে। এতগুলো মেগাপ্রকল্প বাংলাদেশ এত অল্প সময়ে বাস্তবায়ন করবে এবং দেখবে সেটি আমাদের রাজনীতির অঙ্গনের অনেকের কাছেই হয়তো অবিশ্বাস্য ছিল। এমনকি নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জকে অনেকেই সন্দেহের চোখে দেখেছিল। তাদের হয়তো আত্মবিশ্বাসের অভাব ছিল। কিন্তু পদ্মা সেতু নির্মাণের পর সেই আত্মবিশ্বাস এখন বাস্তবতা। ফলে বাকি মেগাপ্রকল্পগুলো শিগগিরই সম্পন্ন হওয়ার পর বাংলাদেশে একটি বড় ধরনের পরিবর্তন সংঘটিত করার সব দ্বার উন্মোচিত হবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু সেই দ্বার উন্মোচনের জন্য পুরনো ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাস, অন্ধত্ব, অনগ্রসর চিন্তা আমাদের ঝেড়ে ফেলে দিতে হবে, পুরনো দরজা-জানালা দিয়ে আগামী নতুন বাস্তবতা দেখা যাবে না। হাতে নিতে হবে নতুন প্রযুক্তি ও চাবি। তাহলেই মেগাপ্রকল্পের সুফল আমরা দ্রুততম সময়ে পেতে শুরু করব। তা না হলে অনেক কিছুই ভেস্তে যেতে পারে। সে জন্য প্রয়োজন হচ্ছে মেগাপ্রকল্পের সঙ্গে সংগতি রেখে গোটা বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক পরিবর্তনে মেগা পরিকল্পনা গ্রহণ করা। এর কোনো বিকল্প নেই।

পদ্মা সেতু উদ্বোধনের পর গোটা দেশ চাঞ্চল্যে ভরে উঠেছে। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এখন দীর্ঘদিনের যোগাযোগ বিড়ম্বনার হাত থেকে মুক্তি পেয়ে উচ্ছ্বাস আনন্দে ভাসছে। পদ্মা মহাসেতু শুধু দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলার জন্যই নয়, গোটা দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অনেক কিছু বদলে দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। দক্ষিণ-পশ্চিমবঙ্গ অবশ্যই এই পরিবর্তনে প্রাধিকার পাবে, এতে সন্দেহ নেই। কিন্তু দেরি না করে এখনই যদি সরকার এই ২১টি জেলার যোগাযোগ যাতায়াত, শিল্প, বাণিজ্য, পর্যটন, সমুদ্রবন্দর, কৃষি, মৎস্য, শিক্ষা, প্রযুক্তি, সংস্কৃতিসহ যত ধরনের স্থাপনা নির্মাণের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন তার মহাপরিকল্পনা গ্রহণ না করে তাহলে অচিরেই এসব জায়গায় অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র যা কিছু মাথা গজিয়ে উঠবে তা দেশে আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় সচলতার পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য ও বিপত্তি বাড়িয়ে তুলবে। আমাদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন অগ্রযাত্রা বাধাগ্রস্তই হবে। সে কারণে এখনই একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়নে হাত দেওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে।

আমাদের ভোলায় প্রচুর গ্যাস পাওয়া গেছে। ভোলার গ্যাস সমগ্র দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কিভাবে উত্তোলনের মাধ্যমে সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়, জরুরি ভিত্তিতে সে ব্যবস্থা নিতে হবে। কেননা ওই অঞ্চলে শিল্প-কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগাযোগ, যাতায়াত ও নানা স্থাপনায় দেশীয় গ্যাসের কোনো বিকল্প নেই। গ্যাসের সেই সুযোগ যেহেতু আমাদের রয়েছে তাই ভোলার গ্যাস উত্তোলন, বিতরণ ও সরবরাহে সামগ্রিক পরিকল্পনা প্রণয়ন অনেকটাই আমাদের হাতের মুঠোয়। দক্ষিণাঞ্চলে কুয়াকাটা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম কোণে সুন্দরবনকেন্দ্রিক যে পর্যটন সম্ভাবনার অপার সুযোগ রয়েছে সেটিকে আধুনিক পর্যটনব্যবস্থায় অপরিহার্য করে তোলার মতো পরিকল্পনা এখনই নেওয়া দরকার। কক্সবাজারের মতো সব কিছু অপরিকল্পিত ও মানহীনভাবে গড়ে উঠলে তা ভবিষ্যৎ পর্যটনে তেমন কোনো আবেদন সৃষ্টি করতে পারবে না।

ঢাকা থেকে কুয়াকাটা, সুন্দরবন যাতায়াত, পর্যটন, যানবাহন ও সংস্কার ব্যবস্থা উন্নত দুনিয়ার মতো এখনই করা দরকার। এ ছাড়া মোংলা ও পায়রা বন্দরকে আধুনিক সমুদ্রবন্দরে পরিণত করার জন্য বিশেষজ্ঞদের নিয়ে সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন জরুরি। তাহলে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য বিদেশের সঙ্গে এই দুটি বন্দর দিয়েও গতিলাভ করতে পারবে, যা গোটা অর্থনীতি এবং মানুষের জীবনব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে পারবে। ২১টি জেলার প্রতিটিতেই আগামী দিনের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য কোথায় কোথায় কী কী শিল্প, কৃষি, বিশেষায়িত অঞ্চল, মৎস্য, শস্য ও শিক্ষা- সাংস্কৃতিক স্থাপনা থাকা জরুরি সেটিও যেন এই মহাপরিকল্পনার অংশ হয়। তাহলেই বিশাল এই অঞ্চলের শহর, গ্রাম, যাতায়াতব্যবস্থা, উৎপাদনব্যবস্থা, আবাসনসহ সব কিছু পরিচ্ছন্ন, নিখুঁত ও পরিবেশসম্মত হবে। সেটি দেশি-বিদেশি সবার কাছেই গ্রহণযোগ্যতা পাবে।

আগামী দিনে যখন রূপপুর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের উদ্বোধন হবে তার আগেই ঈশ্বরদী, পাবনাসহ উত্তরবঙ্গের জেলাগুলোর গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো বিবেচনায় নিয়ে একটি অঞ্চলভিত্তিক পরিকল্পনা নিয়ে মহাপরিকল্পনায় যুক্ত করা অপরিহার্য। তাহলেই আমাদের উর্বর কৃষিজমি নষ্ট হবে না, যত্রতত্র বাড়িঘর বিলাস স্থাপনাও তৈরি হবে না। আমাদের দেশটি ছোট, মানুষের সংখ্যা আয়তনের তুলনায় বহুগুণ বেশি। এই মানুষদের যেমন খাদ্যের চাহিদা পূরণে কৃষিজমি, মৎস্য আধার, ফলদ ভূমি, বনজসম্পদ, পশুর চারণভূমি দরকার, একই সঙ্গে পরিবর্তিত উন্নয়ন ধারায় আবাসিক শহর-নগর থাকা দরকার। কিন্তু আমাদের বেশির ভাগ নগরী অপরিকল্পিতভাবে তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগ নগরীতেই নাগরিক সেবাধর্মী সুযোগ-সুবিধা নেই। মেগা সব প্রকল্প একের পর এক বাস্তবায়িত হলে সর্বত্র পরিবর্তনের সম্ভাবনা তৈরি হবে। ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে দেশব্যাপী এই পরিবর্তনের ধারা ছড়িয়ে দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই। সেই মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করা হলে ঢাকার ওপর অযাচিত চাপ কমে আসবে। উন্নয়ন বৈষম্যও হ্রাস পেতে থাকবে। জনস্রোতও ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়ে যার যার এলাকাকেন্দ্রিক হওয়ার পরিবেশ তৈরি হবে। আধুনিক অর্থনীতির মূল আকর্ষণ হচ্ছে মানুষকে তার পছন্দের জায়গায় কর্ম ও সৃজনশীলতায় বেড়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া। প্রযুক্তির এই যুগে মানুষের কেন্দ্রীভূত হওয়ার কোনো প্রয়োজন পড়ে না। তবে এর জন্য চাই নিখুঁত পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনায় থাকতে হবে মানুষের বাসযোগ্য পরিবেশ, প্রয়োজনীয় সব সেবা। তাহলেই সমাজ বিনির্মিত হবে আধুনিক সভ্যতার আদর্শে। সেটি আমরা এত বছর করতে পারিনি। সে কারণে আমাদের আর্থ-সামাজিক রাজনৈতিক নগর ও গ্রামীণ ব্যবস্থায় নেমে এসেছে চরম নৈরাজ্য ও মানবিকতার অভাব। এর পরিবর্তন ঘটাতে তাই চাই মেগাপ্রকল্পের বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে মেগা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক জীবনব্যবস্থার পরিকল্পনা। সেই পরিকল্পনা ছাড়া চলমান মেগাপ্রকল্পের প্রভাব কার্যকারিতা হারিয়ে ফেলবে। 

সর্বশেষ
জনপ্রিয়